তরুণ ভোটারের চোখে একাদশতম জাতীয় নির্বাচন

~শাহাদাৎ সরকার

একাদশতম জাতীয় নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, সেই সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে জনমনে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা। সেই জল্পনা-কল্পনার মধ্যে আতংকের পরিমাণ বেশী। বিশেষত, এই জল্পনা-কল্পনার মধ্যে সবচেয়ে আগে যে প্রশ্নটি (অন্য সকল তরুণের মত) আমার মনেও বারবার জাগছে তা হলো এই, এবার নির্বাচনে কি গণতন্ত্রের মহত্তম জয় ঘটবে? নাকি স্বৈরাচারিত্বে বিজয় পতাকা সাধারণ জনগণের নাকের ডগায় ভর করে আবার পতপত করে উড়বে? সেই কল্পনার কিছুটা নমুনা এই কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। এমনকি ঐক্যফ্রন্টের একজন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারে গেলে পুলিশ তাকে গুলি করতেও দ্বিধা করেনি। যদিও বরাবর ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে লেভেল প্লানিং ফিল্ডের কথা শোনা যাচ্ছে, পাশাপাশি তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তি হিসাবে নিজেদের জাহিরের সাথে সাথে গণতন্ত্র রক্ষায় চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন বলেও দাবী করছেন। কিন্তু তাদের আচারণ বিধি দেখে প্রশ্ন জাগছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি এই নির্মম সন্ত্রাসকে সমর্থন করে? কেননা দেখা যাচ্ছে সরকার বরাবরই সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছেন নির্বাচনে জেতার জন্য। আমি যে এলাকার ভোটার সে এলাকায় পুলিশি তৎপরতায় সাধারণ জনগণের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এমনকি তারা বাড়িতেও নির্বিঘ্নে রাত কাটাতে পারছেন না। তবে এই চিত্র যে শুধু নির্বাচনকালীন সময়ে এমনটিই নয়। বরং এই চিত্রের অবতারণ হয়েছে ২০১৩ সালের অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সূচনা থেকেই। আর তা ক্রমান্বয়ে পৌছে গেছে চরমতম পর্যায়ে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও যে ধরনের আচরণ করছে তাতে করে তা আমাদের সামনে এক ধরনের ধাঁধাঁ তৈরি করছে। সরকার বুঝাতে চাচ্ছে,  এই দশ বছরে উন্নয়ন হয়েছে। বাকি সময় উন্নয়ন হয়নি। অবশ্য জনগণের বুঝতে বাকি নেই যে, উন্নয়ন একটি স্বাভাবকি প্রক্রিয়া, এটি কোন মন্ত্রবল নয়, উন্নয়ন হচ্ছে বললেই হয়ে গেল। বরং এই সরকারের আমলে যেটি হয়েছে তা হল জননিরাপত্তা কমেছে, পাশাপাশি হয়েছে ব্যাপক হারে রাষ্ট্রীয় অর্থভা-ার লুট। তাতে অনেক মন্ত্রীকে দেখা গেছে  খুব গুছিয়ে সেই লুটেরাদের সমর্থন করতে। আবার যখন জননিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে কোন আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে তাতেও সরকার পতনের ভূত দেখতে পেয়েছেন। আর সেই সব আন্দোলনকে ভুন্ডল তো করেছেনই, তার পাশাপাশি এই সব আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতাকর্মীদেরকে দ্বিধাহীন চিত্তে গুম করেছেন। যদিও সেই সব আন্দোলনের উদ্দেশ্য কখনই রাজনৈতিক ছিল না। বরং তা ছিল আমাদের জননিরাপত্তার পক্ষে। যদিও বারবার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই বলছেন জনগনের সাথে আছেন। কিন্তু জনগণের বিষয়ে সেরকম কোন কর্মকা- দৃশ্যতঃ পরিলক্ষিত হয়নি। যা হয়েছে তা কুল রক্ষার চেষ্টায়।

এদেশের একটা বিশাল অংশ তরুণ। এই তরুণ সম্প্রদায়ের সমস্যার বিষয়-আশয় নিয়েও খুব একটা চিন্তা যে আওয়ামী লীগ করছেন তা মনে হচ্ছে না। পাশাপাশি বিরোধীদলও নিরব। তাদের ভাবখানা এরকম কেউও একজন এসে তাদের রূপকথার পাতালপুরী থেকে রক্ষা করবেন। এমনকি কোন নায্য আন্দোলনকে সমর্থন করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতেও দেখি না বিরোধী দলকে। বরং তারা একার্থে হয়ে পড়েছে প্রেসরিলিজের দল। আর তা দেখে জনগণের মনে ধারণা জন্ম নিতে শুরু করেছে, এই গেলেও যা, সে গেলেও তা। তা করে আমাদের কোন লাভ নেই, আর ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। বরং আমাদের খেটে খেতেই হবে। কিন্তু বিরোধী দলও সাধারণ জনগণের কাছে গিয়ে কখন বুঝাতে সক্ষম হয়নি যে নুন্যতম গণতন্ত্র থাকলে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে নিরাপত্তার সাথে বাঁচতে পারবে। এমনকি বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মীর বিষয়ে অভিযোগ আছে যে, তারা এই ১২ বছরে তাদের নির্বাচনী এলাকায় একবারের জন্যেও জাননি। অথচ এখন তাদের অনাগোণার শেষ নেই। এটি যে কোন দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চরমতম হুমকি। ফলে জনগণ যেমন সরকারে প্রতিও আস্থা হারিয়েছে, তেমনি আস্থা হারিয়ে বসেছে বিরোধী দলের প্রতিও। তবে এই নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণের আস্থা ফিরাতে পারেন ঐক্যফ্রন্ট। দৃশ্যতঃ অনেকটায় সক্ষম হয়েছে বলেও মনে হচ্ছে।  তারা তাদের প্রচার অভিযানে কাজে লাগাতে পারে তরুণদের। এমনকি তরুণ ভোটারদের বিষয় সামনে রেখে নির্বাচনে বিশেষ কিছু ইশতেহার তারা নিয়েছেন। যা বেকার তরুণদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়ক হবে। কেননা, এই কয়েক বছরে বেকারত্ব বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আর যে বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন তাহলো মেধাবীদের চাকরীতে গুরুত্ব দেয়া, কোঠা পদ্ধতির মাধ্যমে দলীয় ক্যাডার নিয়োগ থেকে বিরত থাকা। কারণ এই পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয়েছে মেধাবী তরুণরা। তারা যোগ্যতা থাকার পরেও চাকরি হতে বঞ্চিত হয়েছে। এমনকি এমন অভিযোগও পাওয়া গিয়ে সব যোগ্যতা থাকারও পরও একজন চাকরি প্রার্থী আওয়ামী লীগ করেন কিনা তা যাচাই বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেই প্রার্থীর পরিবারে কোন একজন সদস্য যদি বিএনপিকে সমর্থন করে থাকে, তাহলেও চাকরি থেকে হয়েছে বঞ্চিত। ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে এমন বঞ্চনার শিকার হতে হবে না মেধাবী তরুণদের, এই রকম নিশ্চয়তা প্রদান করলে তা বিরোধী জোটের ভোট প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে বলে অনুমেয়।

আর আরেকটি লক্ষ্যযোগ্য বিষয় হলো এই যে, বিরোধী দল তাদের প্রচার অভিযানে গিয়ে বাঁধা প্রাপ্ত হলেই ভেঙে পড়েন। যা আওয়ামী সরকারকে আরো বেগবান করে স্বৈরাচারের দিকে। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের প্রতিবাদী ভূমিকা আরো জোরদার করা জরুরী। আরেকটি গুরুতর অভিমত বিরোধী দল সম্পর্কে শুনে খুব মর্মাহত হতে হয় যে, তারা পুলিশি বাঁধা পাওয়ার আগেই পুলিশ দেখলে নিজেদের গুটিয়ে নেন। এমনকি আন্দোলন করার নতুন প্রক্রিয়াও আবিস্কার করে ফেলেছেন; যা বিরোধী দল হিসাবে শোভনীয় নয়। তাদের উচিত হবে এমন পরিবেশ তৈরি করা পুলিশ যাতে বাধ্য হয় গ্রেতার বন্ধ করতে। কেননা, একজন হলে বা দশজন হলে পুলিশ গ্রেফতার করবে। কিন্তু একসাথে ১০০ বা ৩০০ জন নির্বাচনী প্রচার অভিযানে বের হলে গ্রেফতার করার সাহস পুলিশের হবে না। কারণ পুলিশ জনগণের টাকায় বেতন প্রাপ্ত কোন সরকারে ব্যক্তিগত ফান্ডে নয়। আর সে কারণেই পুলিশকে সাধারণ জনগণের পক্ষ নিতে বাধ্য থাকতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক মঞ্চে যে নাটক হতে যাচ্ছে তাতে এখন স্পষ্টতঃ দুটি দল সক্রিয় একটি গণতন্ত্রের পক্ষে অপরটি উন্নয়নী গণতন্ত্রের(বিশেষ ধরনের স্বৈরাচার) পক্ষে। এই পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সেই সাথে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে জনগণকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দেয়া। তারা আসলে দেশকে কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষা করতে চাই? নাকি ভারতীয় তাবেদার রাষ্ট্র্রে পরিণত করতে চাই।

Back To Top