করোনা আবহে আমার দেশ

~পাশারুল আলম

গোটা বিশ্ব আজ ভারতকে আছ্যুৎ করে রেখেছে। চাতক পাখির মতো মুমূর্ষু রোগী অক্সিজেনের জন্য চেয়ে আছে। আমরা যারা এখনো নিজেকে মুক্ত ভেবে বসে আছি তাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে করোনা নামক এক ভাইরাস। এটা কি ভবিতব্য ছিল নাকি আমাদের গাফিলতির ফলে হারিয়ে যেতে বসেছি আমার প্রতিবেশী আমার স্বজন। আজকে আর্তনাদ শোনার কেউনেই। হায়রে ভারত ভাগ্য বিধাতা।

ভয় করে বড্ড ভয় করে টিভির পর্দায় বসতে। নিজের মৃত্যু ভয়ে নয়। মৃত্যু মিছিল দেখে। এই তো কয়দিন পূর্বে রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনী মিছিলের আস্ফালন। আজকে প্রকৃতির প্রদত্ত প্রাণবায়ুর অভাবে আমরা কত অসহায়। একদিন নয় একমাস নয়, বছর পেরিয়ে গেছে করোনার আগমন।
চোদ্দ মাস পরেও দিকে দিকে আর্ত মানুষ আর পরিজনের হাহাকার। অসহায় মানুষের জীবন যুদ্ধ। চাই অক্সিজেন, চাই ওষুধ, চাই পরিষেবা। এই রকম করুন অবস্থা মানুষ কোনোদিন দেখেনি । নেই আর নেই। জীবন নিয়ে এই কি খেলা।

খেলা তো বটে। কিসের খেলা ? কে দায়ী আজকের এই মর্মান্তিক অবস্থার জন্য । আমরা সবাই সবার দিকে চেয়ে দোষ চাপিয়ে খালাস হতে চাই। দোষ চাপিয়ে আড়ালে পালানোর এক প্রচেষ্ঠা। কারো না কারো দোষ আছে। এই দোষের ফল জনগনের ভাগ্য। এই ভাগ্য নির্ধারণ করেছি তখন যখন আমরা তবলীগ জামাত ওয়ালাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেরা দোষ মুক্ত হতে চেয়েছি। সরকারের সেই আবেদনে আমরা সবাই সাড়া দিয়েছি। বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে একবারও ভাবিনি। ওরাতো আটকা পড়েছিল। ওরা ভাইরাস ছড়ায় কিভাবে ? তবু মিডিয়ার চালে আমরাও দৃষ্টিহীন হয়ে এক তরফা বিচার করে দেশ আর দেশবাসীকে কম হেনস্থা করিনি। সেদিন যদি সঠিক প্রশ্ন হত। তাহলে হয়তো আজকের এই অসামান্য পরিস্থিতি দেখতে হত না।

আমাদের দেশের নির্বাচনী ইস্যু কি ছিল। মন্দির মসজিদ, ৩৭০, তিন তালাক, সবাইকে জয় শ্রীরাম বলতে হবে। বার বার বলা হয়েছে এক দেশ, এক আইন, এক দেশ এক ধর্ম, এক দেশ এক ভাষা । কেউ বলেনি এক দেশ এক স্বাস্থ্য নীতি। কেউ প্রশ্ন তুলেনি দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার হল কেমন আছে। তাই দেশের পঁয়ষট্টি শতাংশ চিকিৎসা ব্যবস্থা চলে গেছে বে-সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে। এই ব্যবস্থায় গরিবের কোনো ঠাই নেই। মানুষ মন্দির মসজিদ নিয়ে ব্যস্ত তখন সরকার মানুষের মন সেদিকে সুচারুভাবে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের শাসন সু-প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেকে বিকশিত করার চেষ্টা করছে। সাধারণ মানুষ এই বিশ্বাসে অনেক কিছু আশা করতেই পারে। যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা আর চিকিসার উন্নয়ন আমাদের কাম্য। দুর্ভাগ্যের বিষয় তেমনটা হয়নি। দেশ ও দেশবাসীর দাবি হওয়ার কথা সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য চিকিৎসা।তা না হয়ে ধর্মের মধ্যে রাজনীতি আর রাজনীতির মধ্যে ধর্ম দিয়ে সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আজকে গোটা দেশ শশ্মানপুরিতে পর্যবসিত হয়েছে।

আমরা বার বার প্রতিবেশী একটি দুর্বল দেশের পরিসংখ্যান দিয়ে নিজেকে উঁচু দেখানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের নির্বাচনে মূল ইস্যু প্রতিবেশী শত্রু দেশ কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা সম্পর্কে নীরব থেকেছি। এই নীরবতায় দেশের নগ্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য দায়ী। সরকার যখন দেখল বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যবস্থা অপ্রতুল তখন অবৈজ্ঞানিক কিছু টটকা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হল। সেই ফাঁদে পা দিয়ে দেশের জনগণ সেই পথে হাটল।

আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি তাই রাজনেতারা আমাদের স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে সব ভুলে বসে আছি। রাজনেতারাও বুঝে গেছে, এদেশের জনগন কি চায়। উন্নয়ন নাকি বিভাজন। এক ক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধি করতে হয় আর এক ক্ষেত্রে বাজেট লুট করা যায়। তাই বিভাজনকেই ভোট বাক্সের চাবি হিসাবে ব্যবহার করেছে। স্বপ্নের বেসাতি করে মূল চাহিদা গুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে বেশ চলছে ওদের রাজনীতি।

এদিকে করোনার দ্বিতীয় ধাপ এসে দেশের আসল চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ সংক্রামিত। হাজারে হাজার মানুষ চিকিৎসা ছাড়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আমরা আগের মতই নির্বাক, নিশ্চুপ। ভাবতে অবাক লাগে এই কিছুদিন পূর্বে পাঁচ ট্রিলিয়ন জিডিপির স্বপ্ন দেখানো হল। সেই রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভুলে গেলাম আমাদের দেশের বর্তমান জিডিপির ১ শতাংশের কম খরচ হয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে। যে পাকিস্তান নিয়ে আমাদের এত রাজনীতি সেই শত্রু দেশ তার জিডিপির ৩.২০ শতাংশ খরচ করে চিকিৎসা বিভাগে। প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আমরা নিজেদের একটু উপরে ভাবি কিন্তু শ্রীলঙ্কা তার জিডিপির ৩.৯৬ শতাংশ খরচ করে চিকিৎসায়। অশান্ত মায়াম্মার ৪.৭৯ শতাংশ, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত আফগানিস্তান ৯.৪ শতাংশ, গৃহ যুদ্ধে জেরবার রোয়ান্ডা ৭.৫৪ শতাংশ, ইউথোপিয়া ৪.৯ শতাংশ, নাইজেরিয়ার মত দেশ ৩.৮ শতাংশ খরচ করে চিকিৎসা খাতে। ইউরোপীয় দেশে ফ্রান্স ১১.২৬ শতাংশ পূর্তগাল তার জিডিপির ৯.৫ শতাংশ খরচ করে। বাকি ধনী দেশের কথা ছেড়ে দিলাম। অবাক হওয়ার মত বিষয় নেপাল খরচ করে ৬.৪২ শতাংশ, বাংলাদেশ ২.৯৭ শতাংশ আর ভুটান ৫.৭৮ শতাংশ। ফলে এই সমস্ত প্রতিবেশী দেশ থেকে মা এবং শিশু মৃত্যুতেও আমরা এগিয়ে। বিশ্ব গুরুর স্বপ্ন দেখে চুপ ছিলাম তাই আমাদের চিকিৎসা খাতে জিডিপির কত শতাংশ খরচ হয় তা জানার প্রয়োজন মনে করিনি। এই বিষয়ে প্রশ্ন করিনি। গত বছর দেশে যখন করোনার প্রবেশ হল, সরকার তার ভিতরেই ব্যবস্থা সম্পর্কে জানত তাই জামাতের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে আড়াল করল। আমরাও সেই সাম্প্রদায়িক বিষ বায়ুতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম। থালা আর তালি বাজিয়ে গো করোনা গো করে বেশ আনন্দে ছিলাম। সরকার অনেক কিছু জানতে পারে তাই পিএম কেয়ার হল, কত টাকা উঠল ? কত খরচ হল ? তা নাকি কারো জানার অধিকার নেই। জনগণের দান করা টাকার হিসেব যারা দেয়না তাদের বিশ্বাস করি কোন আক্কেলে।

আজ যখন করোনায় মানুষ মরছে তখন কিছু কিছু বরাত দেওয়া হচ্ছে কিন্তু মোট কত টাকা আদায় তার জমা খরচের হিসাব কি, তা নাকি দেশের জনগণের জানার অধিকার নেই। এই অধিকার ভুলে গেছি তাই দেশের এই হাল।

এবার যখন করোনার দ্বিতীয় ধাপ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভয়ানকভাবে চেপে ধরেছে, তখন আমরা সবাই হায় হায় করছি। এবার সরকার নিজের দোষ দেবার মতো কোনো আধার না পেয়ে রাজ্য সরকারকে দায়িত্ব নিতে বলছে, অথচ গত বছর সব দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে রাজ্য সরকারের ক্ষমতাকে খর্ব করেছে। যে কোনো কারণেই হোক গতবার করোনার প্রকোপ এবারকার মতো জোরালোভাবে আসেনি। তাই কেন্দ্র সরকার এই রকম ঘোষণা দিতে কুন্ঠিত হয়নি যে, আমরা করোনা জয় করেছি।
এটা যে জয় ছিল না, সেটা ছিল মাত্র একটা ইন্টারভ্যাল তা এবার হারে হারে টের পাচ্ছি।

এই রকম পরিস্থিতির জন্য বিদেশী সংবাদ মাধ্যম আমাদের দেশের নেতৃত্বকে দায়ী করছেন। দেশের সরকার তা মানতে রাজি নয়। জানা যাচ্ছে গত নভেম্বর মাসে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় ধাপ ধেয়ে আসছে কিন্তু আমাদের দেশের সরকার সমূহ সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর দেয়নি। এদের কাছে সরকার গঠন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। তাই একের পর এক জনসভা করে চলেছে নির্বিচারে। তার ফল ভোগ করছে আপামর জনগন।

এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সরকার হতভম্ব হয়ে উত্তর খুজে ফেরে। শ্মশান আর কবর স্থানের রাজনীতি কর্পূরের মত উড়ে যেতে বসেছে। তাই ধর্ম নয়, বিভাজন নয়, বিভেদ নয়, সবাই আসুন ভারতীয় হয়ে ভারতকে রক্ষা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top