এনআরসি, এনপিআর এবং সিএএ নিয়ে বিজেপির দূরভিসন্ধি

~তায়েদুল ইসলাম

বিজেপির সব নেতাই গোয়েবলসীয় কায়দায় বলেই চলেছে সিএএ দ্বারা কারো নাগরিকত্ব বাদ যাবে না। কোন ভারতীয়র নাগরিকত্ব যাবে না। এটা নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন নয়। নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন। আপাতত এ দাবির মধ্যে কোন ভুল নেই। কিন্তু বিরোধীরা বিজেপির এই দাবির বিরোধিতা করছে না। বিরোধীরা বিরোধীতা করছে এই জন্য যে, নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হচ্ছে। অর্থাৎ যারা ভারতীয় নন তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা (এ ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব ) দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে পার্থক্য করা হচ্ছে। এটা তো অবশ্যই সংবিধানের আইনের চোখে সবাই সমান শিক্ষার লঙ্ঘন। বিজেপি বিরোধী অথচ সিএএ-র সমর্থক কেউ কেউ বলছেন সিএএ তত্ত্বগত ভাবে সংবিধান বিরোধী ও বিভেদ মূলক হলেও বাস্তবে মুসলিমদের কোন সমস্যা হবে না। তাদের বক্তব্য সিএএতে উল্লেখিত তিনটি দেশ থেকে মুসলিমরা আসেননি। এখানেই বিজেপির দূরভিসন্ধি লুকিয়ে আছে। এটা বুঝতে হলে দেশের নাগরিকত্ব আইনকে ভাল করে বুঝতে হবে। কেবল সিএএটুকুই সম্পূর্ণ নাগরিকত্ব আইন নয়। এটি নাগরিকত্ব আইন এর এখন পর্যন্ত সর্বশেষ সংশোধনী। ফলে এটি মূল নাগরিকত্ব আইন থেকে আলাদা স্বয়ং সম্পূর্ণ কোন আইন নয়। নাগরিকত্ব আইন প্রথম তৈরি করা হয় ১৯৫৫ সালে। কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী সহ সব সংশোধনী মিলেই নাগরিকত্ব আইন। সমগ্ৰ নাগরিকত্ব আইনের উপর চোখ রাখলেই বোঝা যাবে সিএএ এর ফলে ভারতীয় মুসলিমদের উপর অনুপ্রবেশকারীর খাঁড়া কী ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ২০০৩ সালের সংশোধনীতে বলা হয়েছে সিএএতে উল্লেখিত তিনটি দেশ থেকে যারাই এসেছেন তারাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। সিএএ বা নয়া নাগরিকত্ব আইনে মুসলিমদের ক্ষেত্রে সে ধারা রদ করা হয়নি। ফলে বর্তমান নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী উল্লেখিত তিনটি দেশ থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন মুসলমান এসে থাকলে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কিন্তু নয়া সংশোধনীতে কত তারিখ থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু সংবিধান বলছে ১৯৪৮ সালের ১৮ জুলাই এর পর তৎকালীন পাকিস্তান থেকে যারা এসেছেন তাদের ভারত সরকারের কাছে আবেদন করে নাগরিকত্ব নিতে হবে। সেটা করে না থাকলে তখন থেকেই তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পরিগণিত হবে। ফলে বিষয়টি এই রকম দাঁড়াল ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐ তিনটি দেশ থেকে আসা ঐ ছয়টি ধর্মের মানুষরা বৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং মুসলিমরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ফলে সিএএ-তে ভারতীয় মুসলিমদের নাগরিকত্ব যাবে না এটা সত্য কিন্তু পাশাপাশি ভারতীয় মুসলিমদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার চক্রান্ত পাকাপোক্ত করে রাখা হল। হয়তো কেউ বলবেন যদি কোন মুসলিম এসে থাকেন এবং ভারত রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন তা হলে তো কোন সমস্যা নেই। এই মন্তব্যটিও ষড়যন্ত্রের অংশ বা ষড়যন্ত্রকারীদের শেখানো কথা। কারণ এই বিষয়টি সিএএ-তে উল্লেখিত ছয়টি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তা ছাড়া অত দিন আগের কাগজ কারো কাছেই থাকা সম্ভব নয়।
আমাদের আশঙ্কা কয়দিন পরেই দাবি করা হবে সকল মুসলিমই অনুপ্রবেশকারী। অর্থাৎ যারা দেশ ভাগের আগে থেকেই এ দেশে আছেন তাদেরকেও বলা হবে তারা দেশ ভাগের পরে পাকিস্তান থেকে এসেছেন । আর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সে দাবি মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব মুসলিমদের উপর বর্তাবে। সেখানে অধিকাংশ মুসলিমই সফল হবেন না। ফলে দেশ ভাগের আগে থেকেই এ দেশে থাকা মুসলিমদেরও অন্যায় ও বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশকারী হতে হবে। এ সমস্যায় সব চেয়ে বেশি পড়বে বাঙালি মুসলিমরা।
তখন এ সব মুসলিমদের কী অবস্থা হবে ? চারটি অবস্থা হবে। কিছু মুসলিমকে জোর করে বিদেশে বহিষ্কার করা হবে। কিছু লড়াই করে কবরস্থানে যাবেন। ভাল অংশকে বন্দিশিবিরে রাখা হবে। বাকি অংশ ইসলাম ছেড়ে দেবেন। তাতে রাজি না হলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করা হবে। তার অর্থ তাদের ভোটাধিকার থাকবে না। নাগরিক অধিকার থাকবে না। আধুনিক দাস হিসেবে থাকবেন। শিল্পপতিদের সস্তা-শ্রমিক হিসেবে সরবরাহ করা হবে। কথিত উচ্চবর্ণের মানুষেরা দলিতদের সাথে যে আচরণ করছে তখন মুসলিমদের সাথে সে আচরণই করবে।
বিজেপি, আরএসএস, সংঘপরিবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করছে কেন ? আসলে তারা চায় মুসলিম মুক্ত ভারত। কিন্তু এত বিশাল সংখ্যক মানুষকে তো হয় কবরস্থান না হয় পাকিস্তান কর্মসূচি দ্বারা নির্মূল করা সম্ভব হবে না। তাই এ দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা। তাদের লক্ষ্য ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা। হিন্দুরাষ্ট্রে কারা নাগরিক হতে পারবেন তা স্বাধীনতার আগেই হিন্দুরাষ্ট্রের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা গোলওয়ালকর দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সে নির্দেশনা হল ভারত যাদের পিতৃভূমি ও পবিত্রভূমি হবে তারাই ভারতের নাগরিক হতে পারবেন। তাদের বক্তব্য ভারত মুসলিমদের পিতৃভূমি হলেও পবিত্রভূমি নয়। তাই মুসলিমরা এখানকার নাগরিক হতে পারবেন না।
মুসলিমরা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের এই দূরভিসন্ধির কথা না জানলেও এ দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরোধী হিন্দু সমাজ সচেতন আছে।

Back To Top