অসমে বাঙালীদের ‘বিদেশী’ সাব্যাস্তের প্রেক্ষাপট

~ তপোধীর ভট্টাচার্য~ (অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য)

অসমে বাঙালী বস্তির ভৌগোলিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত কী?

ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার পরে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ সবচেয়ে বেশি পেয়েছিল বাঙালী। মনে রাখা দরকার, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কলকাতাই ছিল ভারতের রাজধানী। ইংরেজি ভাসাজ্ঞান থাকার ফলে বাঙালীদের মধ্যে দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ সরকার প্রশাসন চালানোর স্বার্থে এদের আইন আদালত, সরকারী কার্যালয়, রেলওয়েতে ও চা বাগাঙ্গুলিতে বিপুল সংখ্যায় নিয়োগ করে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো অসমেও বাংলাভাষী মানুষ বিভিন্ন জীবিকাসূত্রে ছড়িয়ে পড়েন। অবিভক্ত অখন্ড ভারতের নাগরিক হিসেবে অসম সহ ভারতের নানা অঞ্চলে বাস করার বইধতা সম্পর্কে কারও মনে কোন প্রশ্ন ছিল না।

বরাক উপত্যকা বৃহত্তর বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও কিভাবে অসমের সাথে যুক্ত হল?

মধ্যযুগের শেষ পর্বে ডিমাছা রাজত্বের অবসান হওয়ার পরে ব্রহ্মদেশের সঙ্গে যুদ্ধে জ্যী ইংরেজ এই অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করে। সুরমা-বরাক উপত্যকার স্বাভাবিক সংলগ্নতা থাকায় এই অঞ্চল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর শাসনে চলে যায়। এই ব্যবস্থা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে অনিবার্য ছিল। কিন্তু ১৮৭৪ সালে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তদানীন্তন অসম প্রদেশকে শক্তিশালীও করার জন্য ব্রিটিশ নিঃশব্দ বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে কাছাড়, সিলেট ও গোয়ালপাড়াকে (সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ) অসমের সাথে জুড়ে দেয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও ১৯১১ সালে তা দ=রদ হয়। কিন্তু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর এই তিনটি জেলার কথা শাসক ব্রিটিশ ও আন্দোলনকারী বাঙালীদের অভিনিবেশ থেকে হারিয়ে যায়। এরই ফলে গোয়ালপাড়াকে অসমীয়া সম্প্রসারণবাদ পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে এবং কাছাড়ের বাঙালীদের সার্বিক সর্বনাশের সূচনা হয়। ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে সিলেট অসমের কবল থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গে ফিরে যায়।

অসমের জঙ্গি বিদেশি খেদা আন্দোলনের নেতাদের দ্বারা উত্থাপিত ভূমিপুত্র (খিলঞ্জিয়া) শব্দটির যৌক্তিকতা কতখানি?

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, ‘অসম শুধু অসমীয়াদের’ আর আরজ্যের প্রথম রাজ্যপাল আকবর হায়দরী জানিয়েছিলেন, অসমের সমস্ত ক্ষেত্রে অসমীয়াদেরই একচেটিয়া অধিকার। বাঙালী জাতির উল্লেখ করে তিনি এও বলেছিলেন, বাঙালীরা এখন থেকে অসমীয়াদের প্রভুত্ব স্বীকার করে তাদের করুণায় বসবাস করতে পারবে। স্বাধীন ভারতের পক্ষে সম্পূর্ণ বেমানান এবং চরম অসহিষ্ণুতা ও জাতি-বিদ্বেষমূলক এই চিন্তাধারা ৭১ বছর প্রে আবারও উগ্র হয়ে উঠেছে। তাদের মতে, অসমীয়াভাষীর প্রভুত্ব স্বীকারকারী জনগোষ্ঠীরাই কেবল ভূমিপুত্র (খিলঞ্জিয়া)। বর্তমান জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরির ক্ষেত্রে এই বক্তব্যই বেপরোয়া ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অসমবাসীদের মধ্যে ভূমিপুত্ররা O.I (Original Inhabitant) বা আদি বাসিন্দা এবং অন্যান্যরা Non Original Inhabitant বা উড়ে এসে জুড়ে বসা বিদেশী। স্পষ্টতই এই বিভাজন ভারতীয় সংবিধানের মৌলনীতি ও মানবসভ্যতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

অসমে ভূমিপুত্রের সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারণ করা হল?

দেশের প্রচলিত আইন আনুযায়ী অসমের শাসকেরা ভুমিপুত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেননি। সুপ্রিম কোর্টের এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট নির্দেশও নেই। এ ব্যাপারে রাজ্যিক সমন্বয়কে প্রতীক হাজেলা মুখ্যত ভাষিক আধিপত্যবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির নির্দেশে যাবতীয় নিয়ম চালু করেছেন। তা ভারতীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কেননা ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভাস ও বিশেষ বিশেষ বাসস্থানের ভিত্তিতে ভূমিপুত্র বলে অনঅসামী জনসাধারণকে অপাংক্তেও করে দেওয়া হয়েছে।

তথাকথিত ভূমিপুত্র বা O.I-রা সত্যি কি তাই? যদি না হয় তাঁরা অসমে কবে এসেছিলেন?
এ সম্পর্কে অসমের বিখ্যাত অসমিয়া ঐতিহাসিক হেড়ম্বাকন্ত বরপূজারী তাঁর ‘History of Assam’ বইয়ে লিখেছেন, ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যান্ড অঞ্চল থেকে থাই অহোমেরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে। ওইসব অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের বিভিন্ন সংঘর্ষে হারিয়ে দিতে তাঁরা নিজস্ব রাজত্ব পত্তন করেন। মনে রাখা দরকার, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিমপ্রান্তে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার রাজ্যের অধিকার বহুদুর অবধি বিস্তৃত ছিল। সে দিক দিয়ে আর্য ও অনার্য জাতিগোষ্ঠী ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নিয়মিয় ভাবে প্রবেশ করত। আর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ঐতিহাসিক বড়পূজারীর মতে, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে কামাখ্যা মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে নবদ্বীপ থেকে ব্রাহ্মনেরা রাজকীয় আমন্ত্রণে প্রবজন করেছিলেন। অন্যদিকে, বরাক উপত্যকায় মণিপুর সংলগ্ন শৈবতীর্থ ভুবন পাহাড়ে এবং বদরপুরে কপিলাশ্রমে ব্রাহ্মন বস্তি শুরু হয় মোটামুটি একই সময়ে। ক্রমশ অব্রাহ্মনেরাও সভ্যতার অনিবার্য নিয়মে এইসব অঞ্চলে প্রবজন করেন। তাই, ভূমিপুত্র কথাটির কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বস্তুত অখন্ড অবিভাজ্য ভারতের সমস্ত অঞ্চলেই যারা বহু সহস্রাব্দ ধরে প্রবজন ও বসবাস করছেন তাঁরা প্রত্যেকেই ভূমিপুত্র। সুত্রাং অসমের রাজনৈতিক ভুগোল ঐতিহাসিক কারণে বদলে যাক না কেন, সমস্ত বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমান ভুমিপুত্র হিসেবে গণ্য।

অসমে বাঙালী মুসলমানদের বসতি কত পুরোনো?

শ্রীহট্ট (সিলেট) যখন তুরস্কদেশীয় ইসলামী  ধর্মগুরু শাহজালালের প্রভাবে মধ্যযুগের সূচনাপর্বে ব্যাপক ধর্মান্তরীকরণ প্রত্যক্ষ করছিল। তাঁর প্রধান শিস্যদের কয়েকজন পূর্বপ্রান্তিক মহকুমা করিমগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। বর্ণাশ্রম শাসিত হিন্দু সমাজের নিচুতলার ব্যাপক অংশ এদের কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হাতে শুরু করে। সুরমা-বরাক উপত্যকায় ক্রমশ এদের উত্তর-প্রজন্ম  মুসলমান বসতির ভিত্তি স্থাপন করে। ব্রিটিশ যুগেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। ফলে বরাক উপত্যকায় বাঙালী মুসলমানেরা ভূমিপুত্র। দেশভাগের পড়ে নিতান্ত কম সংখ্যক বাঙালী মুসলমান এদিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবজন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংলগ্নকালে বরাক উপত্যকায় সামান্য কিছু বাঙালী মুসলমান এসে থাকতে পারেন। প্রাথমিক অনিশ্চিত পর্যায় শেষ হওয়ার পড়ে বাংলাদেশে যখন স্থিতাবস্থা এল, বাস্তব কারণেই বরাক উপত্যকায় মুখ্যত ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষিজীবী বাঙালী মুসলমানদের ব্রিটিশ শাসক অসমের অনাবাদী অঞ্চলে কৃষিকাজ করার জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ইচ্ছুক কৃষিশ্রমিকদের ঘাটতি থাকার ফলে ব্যাপক হারে প্রবজন ঘটে। সরকারি পোষকতায় বিশ শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালী মুসলমানদের এই প্রবজন চলতে থাকে। তখনকার ঔপনিবেশিক আইনও এই প্রক্রিয়ার সহায়ক ছিল। এদের নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রমে অসমের দুর্গম বনাঞ্চল ও চরাঞ্চল ক্রমশ শস্যশ্যামল হয়ে উঠেছে।

অসমের প্রধান ভাষাগোষ্ঠী কারা?

অসমিয়া, বোড়ো, ডিমাছা, মণিপুরি (মৈতৈ), বিষ্ণুপ্রিয়া, আহোম, কারবি, মার, কুফি ইত্যাদি ভাষাগোষ্ঠী প্রধান। বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বরাক উপত্যকা মিলিয়ে ১ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি। তবে এদের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিশেষ কিছু অঞ্চলের বাঙালীদের নানাভাবে প্রভাবিত করে তাদের মাতৃভাষা অসমিয়া বলে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এনআরসি মানে কী?

এনআরসি’র পূর্ণরূপ হল National Register of Citizen, অর্থাৎ জাতীয় নাগরিকপঞ্জি। নামে জাতীয় হলেও কার্যত তা অসমের নাগরিকপঞ্জি। কেননা পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা সহ ভারতের অন্য রাজ্যের যে সব জাতক জাতিকা বৈবাহিক সূত্রে অসমে রয়েছেন, তাদের নানাভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। তাছাড়া ভারতের অন্য কেন কোনও রাজ্যে এই নাগরিকপঞ্জি নবায়ন হচ্ছে না। ১৯৫১ সালের প্রথম নাগরিকপঞ্জিটি আশ্চর্যজনক ভাবে  সরকারি হেফাজত থেকে উধাও হয়ে গেছে।

অসমে এনআরসি নবায়নের কাজ কীভাবে হচ্ছে?

ভারতের সুপ্রিমকোর্টের তত্ত্বাবধানে রাজ্যিক সমন্বয়কে প্রতীক হাজেলার নির্দেশে এই কাজ চলছে। ২০১৬ সালে এই জন্যে যে প্রথম নির্দেশিকা জারি হয় তা পরবর্তীকালে নতুন নতুন নির্দেশিকা প্রচার করে জটিলতর করে তোলা হয়েছে। বিশেষত ভূমিপুত্র ও অভুমিপুত্রের অসাংবিধানিক বিভাজন আরোপ করে বাঙালীদের নাগরিকপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত করার পথে অজস্র বাঁধা তৈরি করা হয়েছে। ভারতবর্ষের অন্য কোথাও যা নেই সেই ‘ডি’ ভোটার (Doubtful Voter) তকমা দিয়ে বাঙালী হিন্দু মুসলমানকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র এখন খোলাখুলি প্রকাশ পাচ্ছে।

নাগরিকপঞ্জি নবায়নের নামে বাঙালীদের কী কী হেনস্থা করা হচ্ছে?

প্রথমত নাগরিকপঞ্জি তৈরির জন্যে সমস্ত বৈধ ভারতীয় নাগরিকের কাছে যে আবেদনপত্র সরকারিভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, তাতে নিম্নলিখিত নথিপত্রের মধ্যে যে কোনও একটিকে এনআরসি তে অন্তর্ভুক্তির জন্যে যোগ্যতার সূচক হিসেবে দাখিল করতে বলা হয়েছিল।

ক) ১৯৫১ সালের রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি। অথবা (খ) ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রকাসশিত ভোটার তালিকা। অথবা (গ) ভুমি ও রায়তী স্বত্বের নথিপত্র। অথবা (ঘ) নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র। অথবা (ঙ) স্থায়ী বাসিন্দার প্রমাণপত্র (PRC)। অথবা (চ) শরণার্থী পঞ্জীয়ন প্রমাণপত্র (Refugee Certificate)। অথবা (ছ) পাশপোর্ট। অথবা (জ) ভারতীয় জীবনবীমা নিগমের পলিসি। অথবা (ঝ) সরকার প্রদত্ত অনুজ্ঞাপত্র/প্রমাণপত্র। অথবা (ঞ) সরকারী / সার্বজনীন সংস্থায় নিযুক্তি সম্পর্কিত প্রমাণপত্র অথাব (ট) ব্যাঙ্ক / ডাকঘরের হিসেবের নথিপত্র। অথাব (ঠ) জন্মের প্রমাণপত্র অথবা (ড) বোর্ড / বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রমাণপত্র। অথবা (ঢ) আদাওলতের নথি / আদালতের প্রক্রিয়াজনিত নথি।

এগুলি ছাড়াও অন্য নথি দুটি যেমন-

১) বিবাহসূত্রে স্থানান্তরিত মহিলারা রাজস্বচক্র আধিকারিক / গ্রাম পঞ্চায়েতের সচিব দ্বারা প্রদত্ত প্রমাণপত্র (১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ মধ্যরাত্রির আগে বা পরের বা যে কোন বছরের হতে পারে) এবং

২) ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ মধ্যরাত্রির আগে প্রদত্ত রেশনকার্ড সমর্থনমূলক নথিরুপে দাখিল করতে পারবেন। এই নথি দুটি ইতিপূর্বে উল্লিখিত চৌদ্দটি নথির যে কোন একটির সঙ্গে সংযোজিত হলে তবেই গ্রহণযোগ্য হবে।

বহু আবেদনকারী নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য একটির বদলে কয়েকটি নথি দাখিল করেছেন। কিন্তু রাজ্যিক সমন্বয়ের তুঘলকি নির্দেশে বেছে বেছে ভাষিক সংখ্যালঘুদের নানাভাবে মানসিক পীড়ন করা হয়েছে।

প্রথমেই সুপ্রিমকোর্টের দোহাই দিয়ে অসাংবিধানিক ভাবে ভূমিপুত্র ও অভুমিপুত্র বিভাজন করে অসমিয়াভাষী ভুমিপুত্রদের নথিপরীক্ষার প্রক্রিয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। অদিকে অনঅসমীয়া ভাষাগোষ্ঠীর জনসাধারণের জন্যে জটিল ছিদ্রান্বেষী পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভাবে বোর্ড / বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটগুলি সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ নথি পরীক্ষা করতে তারা অস্বীকার করায় আবেদনকারীর দরখাস্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। যেন এনআরসি  কর্তৃপক্ষ ধরে নিয়েছেন যে অনঅসমীয়া ভাষাভাষী ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকপঞ্জিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করার বদলে লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছে।

তৃতীয়ত, ভারত সরকার দ্বারা বহু অনুসন্ধানের পড়ে প্রদত্ত পাসপোর্ট পর্যন্ত এনআরসি কর্তৃপক্ষ স্থগিত করে রেখে দিয়েছে। এইরকম হাস্যকর ব্যাপার ঘটেছে আয়কর বিভাগ প্রদত্ত প্যানকার্ড সম্পর্কেও। অথচ সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট থেকে এর বৈধতা পরীক্ষা সম্ভব ছিল।

চতুর্থত, রাজ্যিক সমন্বয়কে প্রকৃতপক্ষে বাঙালীবিদ্বেষী ছাত্র সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়ে এনআরসি প্রক্রিয়া বহুদুর এগিয়ে যাওয়ার পড়ে বংশবৃক্ষ পরীক্ষা নামক অদ্ভুত ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে অসমের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে  দরিদ্র মানুষেরা সপরিবারে (অতিবৃদ্ধ, শিশু সহ প্রভৃতি সহ) ছুটোছুটি করতে বাধ্য করেছেন। এদের প্রতি যে অবর্ণনীয় নিপীড়ন হয়েছে তা সভ্য সমাজে অকল্পনীয়।

পঞ্চমত, এনআরসি প্রক্রিয়া যখন শেষপর্বে, রাজ্যিক সমন্বয়কে ১লা ও ২রা মে পরপর দুটি ফরমান জারি করে জানিয়েছে, কোনও পরিবারের একজন সদস্যও যদি কোনও কারণে অভারতীয় বলে গণ্য হন, তাঁর পরিবারের কোন সদস্যের নামই নাগরিকপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত হবে না।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালীন অসম পুলিশ ইচ্ছেমত বাঙালী হিন্দু-মুসলমানদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করেছে। এছাড়া সীমান্তরক্ষী বাহিনীও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে অশিক্ষিত ও অসহায় জনসাধারণকে নানাভাবে সন্ত্রস্ত করেছে। এইসব ঔপনিবেশিক শাসনের কথাই মনে করিয়া দেয়। রাজ্যের প্রতাপশালী মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছেন যে বহু লক্ষ নাম বাদ যাবে। এই সবই প্রমাণ দিচ্ছে যে এনআরসি প্রক্রিয়া চলছে পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং এইজন্যে তা বিশাল ধাপ্পা ছাড়া আর কিছুই নয়।

অসমে কবে প্রথম বাঙালী হিন্দু-মুসলমানকে ডি-ভোটার বলে চিহ্নিত করা হয়? কিসের ভিত্তিতে? এদের মোট সংখ্যা কত?

ভারতের অন্য কোথাও যা নেই, বাঙালী-বিদ্বেষী অসম সরকার সেই ডি-ভোটার (ডাউটফুল ভোটার) তকমা চাপিয়ে দেয় ১৯৯৭ সালে। এদের মধ্যে বেশকিছু মানুষের বিদেশী নাগরিক আইন বাবদ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। সেখানে বিচারকেরা বলেন তাদের ভাষা-পোশাক, চেহারা, খাদ্যাভাস বিবেচনা করে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মোট সংখ্যা ৩ লক্ষ ৭০ হাজার। গত ২১ বছরেও বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি বলে এরা রয়ে গেলেন অবাঞ্ছিত ও অবজ্ঞার অন্ধকারে নির্বাসিত।

অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার মূল ভিত্তি-দলিল কী?

অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার জন্যে মূল দলিল হিসেবে ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জি ও ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকাকের প্রধান ভিত্তি স্বরূপ দলিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, এই দুটির কোন একটিও পূর্ণাঙ্গ বা নিখুঁত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। ফলে দুটি অস্তিত্বহীন দলিলের ভিত্তিতে নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রস্তাব অসমের ভাষিক সংখ্যালঘুদের (মুখ্যত বাঙালী হিন্দু-মুসলমানকে প্রতারণা করার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। মনে রাখা দরকার, ১৯৫১ সালে জেলাভিত্তিক যে নাগরিকপঞ্জিকা তৈরি হয়েছিল তখন মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড প্রভৃতি স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে ওঠেনি, সবই ছিল অসমের অংশ। তাই ওখানকার বাঙালী হিন্দু মুসলমান ধীরে ধীরে অসমের নানা অঞ্চলে সরে যেতে থাকেন। এছাড়া জীবিকার খোঁজে, অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছিন্নমূল হয়ে বহু মানুষ নতুন নতুন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। এই প্রক্রিয়া মানব সভ্যতায় অপরিহার্য কিন্তু এর ফলে বর্তমান ভাষিক আধিপত্যবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নাগরিকপঞ্জি নবায়নের প্রক্রিয়ায় এইসব অন্তর্দেশীয় প্রবজনকারীদের নাম ব্যাপকভাবে বাদ পড়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নামে মাত্র ভিত্তিবর্ষ। স্পষ্টতই পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাভাষীরা ‘বহিরাগত’, ‘বিদেশী’, ‘বাংলাদেশী’ বিশেষণে ভূষিত হচ্ছেন।

Back To Top