“আসুন সকলে মিলে দেশ বাঁচাই”  শীর্ষক সেমিনার আয়োজন অল ইন্ডিয়া ইমামস কাউন্সিলের  

 

 

 

দিনকাল দেস্কঃ অল ইন্ডিয়া ইমামস কাউন্সিলের পরিচালনায় বীরভূম রামপুর জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল “আসুন সকলে মিলে দেশ বাঁচাই”  শীর্ষক ঐতিহাসিক সেমিনার। এই সেমিনারে ২০০০ এর অধিক  ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক,  স্কুল শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজসেবীরা অংশগ্রহন করেন।

সেমিনারের মূল লক্ষ্য সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছাত্র, যুব সহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করা। তাদের কে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার কথা বলা। মানুষ মানুষের জন্য সেই কথা তাদের বোঝানো। একে অপরের প্রয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে ঝাপিয়ে পড়া সহ নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

১। ধ্বংসের সূচনা: পরিকল্পিত পিটিয়ে হত্যা, কৃষক, সাংবাদিক ও দলিতদের হত্যা, পুরোহিত ও করসেবক দ্বারা মহিলা ও শিশুদের যৌন হেনস্তা, গোরক্ষার নামে ফাঁসি ও হত্যা, শিক্ষাঙ্গনগুলির গৈরিকীকরন ও সংখ্যালঘুদের প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা হরণ। মুসলিম অমুসলিম মিশ্রিত এলাকায় গরুর মাংস, লাভ জিহাদ, সূর্য নমস্কার ইত্যাদির মাধ্যমে আবহাওয়া বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি। পরিকল্পিত ভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুসলিমদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে অত্যাচার। দেশের জেলগুলিতে ৫৭% নিরপরাধ মুসলিম বন্দি। এমনই বিষময় পরিস্থিতিতে প্রচার মাধ্যমও সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য প্রমাণে নিয়োজিত।

দর্শকের একাংশ

২। দমবন্ধ করা মুদ্রাস্ফীতিঃ রেল ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, ডিজেল, পেট্রল ও গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। RTI এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারত ১৫ টি দেশকে পেট্রল ৩৪ টাকা লিটার, ২৯টি দেশকে ৩৭ টাকা লিটার ডিজেল সরবরাহ করে থাকে কিন্তু অবাক হওয়ার কথা, সেই পেট্রল, ডিজেলের দাম আমাদের দেশে ১০০ ছুঁই ছুঁই। GST-এর এর নামে সারা দেশবাসীর দমবন্ধ অবস্থা, আর এইসবের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু সহ জীবনদায়ী ওষুধের দাম আকাশ ছোঁয়া। একটি তথ্য অনুযায়ী ১০ টাকার ঔষধ মোদী জামানাই ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না।

৩। দেশের সঙ্গে ধোকা ও কেলেঙ্কারি: রাফেল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা দেশের ক্ষতি হয়েছে। বিগত চার বছরে মোদী দেশের অর্থ ১৩ হাজার কোটি টাকা শুধুমাত্র বিদেশ ভ্রমনে খরচ করেছে যার ফলাফল শূন্য। মেক ইন ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্টারটপ ইন্ডিয়া, স্মার্ট সেন্টার, লোকপাল বিল, দুর্নীতি দমন, মহিলাদের সুরক্ষা, কালো টাকা উদ্ধার, ১৫লাখ টাকা প্রত্যেকের একাউন্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, বছরে দুই কোটি চাকরি, এসব দেশ ও দেশবাসীর সঙ্গে সম্পূর্ণ ধোঁকা প্রমাণিত হয়েছে ।

৪। নোটবন্দি সম্পূর্ণ দেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত: নোট বন্দির বৈধতা প্রমাণের জন্য প্রথমে সন্ত্রাস দমন, তারপর কালোটাকা উদ্ধার করে প্রত্যেকের একাউন্টে ১৫ লাখ টাকা প্রদানের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ক্যাস লেস ইন্ডিয়া বানানোর স্বপ্ন, কিন্তু তা কি হয়েছে? বরং এসব করতে গিয়ে ১৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব বাজারে ভারতের মুদ্রামান ২.৭ নিচে নেমে গেছে। রিজার্ভ ব্যাংক এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২.২৫ লক্ষ্য কোটি টাকা দেশের ক্ষতি হয়েছে। এর জন্য দায়ী কে এবং এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে ?

ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক স্বীকার করেছে যে, বিগত চার বছরে ২৩ হাজার ব্যাংক দুর্নীতি হয়েছে। যার মাধ্যমে একলক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সমকামিতা সম্পূর্ণ আইন ও নীতি বিরুদ্ধ, তার পরেও তার বৈধতা প্রদান দেশের আইনকে দুর্বল করার শামিল। বিবাহিতা মহিলা অন্য কোনো পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়লে তা অপরাধ নয়। এই ধরনের মানবতা বিরোধী আইন পাস করে দেশের জাতীয় ঐতিহ্য ধ্বংস করা হচ্ছে ।

এদেশে বিগত ৭০ বছরে প্রায় ৫০ লাখের বেশি নিরপরাধ মুসলিম কে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু তার কোন প্রতিবাদ হয়নি। ফ্যাসিবাদী সংগঠন ঘোষণা করেছে দেশের সেনা বাহিনী ছয় মাসে যা করবে আরএসএস তা তিন দিনে করবে। ন্যায় বিচার ও অধিকার ধ্বংসের জন্য বড় বড় শিল্পপতি ও গুজরাট দাঙ্গার নথি পত্রে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া। রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য জনগণের সম্পদ ও প্রাণ নিয়ে খেলা করা আরএসএস, বিজেপির পুরোনো খেলা। ‘এনআরসি’ লিষ্ট তৈরি করতে জনগণের প্রায় ১২০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। যার কোন প্রয়োজন ছিল না বলে মতামত অনেকের। এর উদ্দেশ্য কেবল মাত্র ভোটের ময়দান পরিষ্কার করা। শুধুমাত্র ইউপি রাজ্যে ৫২ লাখ মানুষের নাম ভোটার লিস্টের বাইরে।

ইভিএম-এর উপর মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। কেননা ইভিএম-এর দ্বারা ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে ৭০% থেকে ৯০% প্রকৃত ফলাফল প্রভাবিত করা যায়। “সবকা সাথ সবকা বিকাশ” ছেড়ে দিয়ে এখন, গীতা, গণেশ, গঙ্গা, গাই, গোবর নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য পুনরায় রাম মন্দির ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে, যদিও এটা সম্পূর্ণ আইন বিরোধী।

৫। আইনকে দুর্বল করার পরিকল্পনা: ‘ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি’-র মতো দেশকে পুনরায় ইংরেজদের হাতে বিক্রয় করার পরিকল্পনা চলছে। মুসলিমদের ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ, তালাক ও হালালার মতো বিষয় কে সম্বল করে সকল ভারতীয়দের জন্য একই আইন (Uniform Civil Code) চালু করার প্রচেষ্টা। সরকার পরিচালিত স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের প্রচেষ্টা। ইতিহাস বিকৃতি, সূর্য নমস্কার, বন্দে মাতরম, গীতা পাঠ এর মতো বিষয় বেআইনি ভাবে সমস্ত ভারতীয়দের উপর চাপিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস। ‘স্রষ্টা’ সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদী ধারণা সমস্ত ভারতীয়দের জাতীয় চেতনা বলে প্রচারণা এবং এর বিরোধীদের দেশদ্রোহী ও গাদ্দার বলে মোহর লাগিয়ে দেয়ার প্রয়াস চলছে।

প্রকৃত শত্রু কে? এদেশের শত্রু কোনো হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, দলিত বা আদিবাসী কেউ নয়। এদেশের শত্রু ওই অপশক্তি, যারা এদেশকে টুকরো টুকরো করতে চায়। জাতীয় ঐক্য নষ্ট করে, জনগণকে বিভক্ত করা। শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাই। যারা দেশের সমস্ত সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে চাই। যারা এদেশের আইন ও আইনি ধারাগুলি ধংস করতে চাই। যারা ভারতীয়দের স্বঘোষিত প্রভু সেজে দেশের স্থায়ী ক্ষমতা ধরে রাখতে চাই। আর তারা হলো আরএসএস, বিজেপি ও তাদের সহযোগী দল ও সংগঠন।

সমাধান কী? -এবিষয়ে সবচেয়ে কার্যকরী ও ফলপ্রসু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো। আর সেটা করতে হলে তাদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য স্থাপন জরুরী। ২০১৯-এর নির্বাচনে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালালে আরএসএস, বিজেপির অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণ তাঁদের ছুড়ে ফেলবে। দ্বিতীয় কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে, বিভিন্ন মতাদর্শের সামাজিক সংগঠনগুলি, যারা দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। তাঁদেরও ঐকবদ্ধ ভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। তৃতীয় কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারেন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের সাহসী পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে উৎসাহ যোগাবে। চতুর্থ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেন সাধারণ জনগণ, তাঁদেরও এ বিষয়ে বুঝতে হবে যে দেশের প্রকৃত শত্রু কে এবং সকলের জন্য ভয়ের কারণ কী কী ? শবিরোধী সকল অপতৎপরতা রোধের জন্য ঘর হতে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশেষত সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এটা জানা জরুরি যে আরএসএস, বিজেপি ওই বিষাক্ত সাপের নাম যার ছোবলে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা জ্বলে পুড়ে শেষ হচ্ছে। তাই তা থেকে বাঁচার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে ঐকবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। আর এই বিশ্বাস সকলের থাকা উচিৎ যে, আমাদের দেশ, সমাজ ও ধর্মের কল্যাণের জন্য আল্লাহ ছাড়া কাওকেই ভয় পাইনা। আর আমরা দেশ ও সমাজের কল্যাণ বিরোধী কোনো শক্তির সাথে সমঝোতা করতে পারি না।

আজকের এই সভায় উপস্থিত ছিলেন অল ইন্ডিয়া ইমামস কাউন্সিলের রাজ্য সভাপতি মৌলানা মোঃ মিনারুল শেখ, সহ সভাপতি আব্দুত তাওয়াব, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওবাইদুল্লাহ নুরী, সমাজসেবী হাকিকুল ইসলাম, শিক্ষক মনিরুল ইসলাম সহ আরও অনেকেই।

Back To Top