পশ্চিমবাংলার মুসলিম সমাজের জন্য সংরক্ষণ

~মুন্সী আবুল কাশেম

ঐতিহাসিক কারণে বাংলার মুসলিম সমাজ পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীঃ

১) ইসলাম ধর্ম নবাব-বাদশাহ ও পীর দরবেশের হাত ধরে বাংলায় প্রবেশ করেছিল। বাংলার সেই সব মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল যারা বেদ পুরাণে হাত দিতে পারত না অথবা যাদের কোন ধর্মীয় আচরণ মানতে দেওয়া হতনা। ইসলামের এক সমন্বয়ী শক্তি এই সব নীচ সম্প্রদায়ের বৃহদাংশ মানুষকে ইসলামের পতাকা তলে টানতে সক্ষম হয়েছিল। সামাজিক দিক দিয়ে তারা ছিল নিষ্পেষিত, দরিদ্র, শোষিত, দাস শ্রেণিভুক্ত। ইসলাম ধর্ম তাদের জীবনে এক প্রত্যাশার দরজা উন্মুক্ত করে।

২) বাংলায় ইংরেজ প্রভুত্ব স্থাপিত হয় নবাব-বাদশাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগে। বাদশাহী শাসন বিলুপ্তি ঘটে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে উচ্চবর্গীয় জমিদারী ব্যবস্থা কায়েম হয়। ইংরেজ রাজশক্তি ও জমিদারদের পেশীশক্তির যৌথ আক্রমণে মুসলমানরা বাস্তুহারা ও জমিচ্যুত হয়ে যায়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- ‘আব্দুল মাঝি, ছুঁচালো তার দাঁড়ি, গোঁফ তার কামানো, মাথা তার ন্যাড়া – তার কাজ পদ্মানদীতে মাঝিগিরি করা আর কাছিমের ডিম সংগ্রহ করা’। জমি থেকে উৎখাত হওয়ার ফলে জল আর জঙ্গল হল মুসলমানের আস্তানা। দীর্ঘ ২০০ বছরের ইংরেজ শাসন সামগ্রিকভাবে মুসলিম জীবনে ডেকে আনে চরম দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা।

৩) ১৯৩৪ সালে হোমরুল (হোমরুল আন্দোলন) চালু হল। বাংলার মুসলমানরা ছিল সংখ্যায় অধিক। মুসলিম জনজীবনের হতাশাকে মূলধন করে সুবিধাবাদী রাজনীতির জনক মুসলিম লীগের আবির্ভাব ঘটে। মুসলিম সমাজের উদারপন্থী কিছু মানুষ মুসলিম লীগকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন বটে – কিন্তু নানাবিধ কারণে লীগের অগ্রগতি রুদ্ধ করা যায়নি। চরম পরিণতি দেশভাগ ও বাংলা ভাগ।

৪) দীর্ঘ ইংরেজ শাসনে মুসলিম জীবনে এসেছে চরম লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, হতাশা ও অবমাননা। জীবনটি তাদের কাছে বিড়ম্বনার প্রতীক। বেঁচে থাকা তাদের কাছে বড়ই দুঃখের, মৃত্যু ছিল তাদের কাছে পরম সান্ত্বনা। এইরূপ পরিস্থিতিতে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী ইসলামের ধর্মীয় বাণীর বিকৃতি ঘটিয়ে বাস্তব জীবনের প্রতি এক অনাসক্ত বোধের উন্মেষ ঘটায়। জীবন ক্ষণস্থায়ী-পরকাল দীর্ঘস্থায়ী। জীবনে নানা ঘাত, প্রতিঘাত ও চ্যালেঞ্জ আছে। পরকালের জীবনে তা নেই। অতএব যে কয়দিন বাঁচো ধর্মীয় আবরণে নিজেদেরকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করো। মৃত্যুই পরম মুক্তি। কি দরকার বেঁচে থাকার জন্য ইংরেজ পুলিশের আর জমিদার লেঠেলদের লাঠির ঘা খাওয়া। কবরে আরবি ভাষায় কথা বলতে হবে। আরবি আল্লাহ্‌-র ভাষা। তাই বেঁচে থাকতে থাকতে আরবী শিখে নাও। মাদ্রাসা তৈরি করো। মাদ্রাসার মাধ্যমে আরবি শেখো। তবেই পরকালে মুক্তি পাওয়া যাবে। এই ভাবে মুসলিম সমাজে মাদ্রাসার আবির্ভাব ও তার রমরমা।

৫) ১৯৪৭ সাল। দেশ স্বাধীন হল, দেশ ভাগ হল। পশ্চিমবাংলায় মুসলমানরা হল সংখ্যালঘু। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ বাংলার মুসলমানদের জীবনে যে সামান্য আলোর রেখে দেখা দিয়েছিল তা প্রদেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল। বাংলা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) ছিল মুসলমান (১৯৩৭-১৯৪৭)। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ তে মুসলমানরা হয়ে গেল সংখ্যালঘুদের একক প্রতিনিধি। একটি অনামি মন্ত্রীত্ব। এটি দয়া না অধিকার তাই নিয়েই চিন্তা ভাবনা।

৬) ‘দয়া না অধিকার’ প্রশ্নটা এই কারণে যে– দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঐতিহাসিক কারণে হতাশাগ্রস্ত পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর জন্য একটু বিশেষে ধরণের সুযোগ সুবিধা থাকা উচিত ছিল কি না – অথবা সরকারের পক্ষ থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন অনুকম্পা বা মানবিক দায়িত্ব থাকা উচিত কিনা?

৭) ভারতীয় সংবিধানে অবশ্য তার উত্তর দেওয়া আছে। কিন্তু সংবিধানের কথা শুনছে কে?

৮) গণতন্ত্র মানে সবাই সমান। কেউ রাজা নয় কেউ প্রজা নয়। কারোর দয়ায় সরকারি চাকুরি বা সরকারি সুযোগ পাওয়া যায়না। যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। শিক্ষাই একমাত্র যোগ্যতা অর্জনের হাতিয়ার। মাদ্রাসা শিক্ষা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করে না। মাদ্রাসা শিক্ষার মোহজাল থেকে সমাজকে বের করে আনতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা শিক্ষার চিন্তা থেকে সমাজকে সরিয়ে আনতে হলে সেই সমাজকে নিজের মত করে ভাবতে শেখাতে হবে – চাপিয়ে দিলে চলবে না। জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, দেশের উন্নয়নের তাগিদে যে শিক্ষার দরকার সেই শিক্ষায় মুসলমানদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। এই উদ্দেশ্যেই ভারতীয় সংবিধানে ৩০ ধারার অবতারণা। এই ধারাটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। বলা হয়েছে, ‘৩০(১) –All Minorities whether based on Religion or language, shall have the right to establish and administer educational institutions of their choice.

৩০(২) –The state shall not, in granting aid to Educational Institutions, discriminate against any educational institution on the ground that it is under the management of a Minority, whether based on religion or Language.

এই ধারায় সংখ্যালঘুদের পছন্দ অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসাবে ভারতের মুসলমানদের ভাবতে হবে- তারা মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে নিমগ্ন থাকবে, নাকি দেশের প্রয়োজনে আধুনিক শিক্ষা ধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশ ও দশের উপযুক্ত করে তুলবে? আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে ৩০(২) ধারায় সরকার আর্থিক সাহায্য দিতে বাধ্য থাকবেন।

৯) কিন্তু আজ পর্যন্ত সংবিধান প্রদত্ত এই ধারার বাস্তব প্রয়োগ হয়েছে কি? মুসলিম সমাজের মানুষকে এ বিষয়ে রাজনৈতিক ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে কি? সামাজিক উদ্যোগে কোন সংস্থা এরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে তাদের প্রতি সরকারি সহযোগিতা সম্প্রসারিত হয়েছে কি? পশ্চিমবাংলায় অন্ততঃ একটি ক্ষেত্রে এরূপ এক উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বারবার আবেদন জানানো সত্ত্বেও সরকারের ভুমিকা নঞর্থক। ফলে মুসলিম জীবনে হতাশা ক্রমবর্ধমান।

১০) স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৫৭ বছর পর ‘ডঃ মনমোহন সিং’ সরকার সংবিধানের ৩৪০ ধারার মর্মার্থ অনুযায়ী ভারতীয় মুসলিম সমাজের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থান কেমন তা তদন্ত করে দেখার জন্য সাচার কমিটি গঠন করেন। ৩৪০ ধারায় বলা আছে, -‘ The President may by order appoint a commission consisting of such persons as a thing fit to investigate the conditions of socially and educationally backward classes within the territory of India and the difficulties under which they labor and to make recommendations as to the steps that should be taken by the Union or any State to remove such difficulties and to improve their conditions and as to the grants that should be made for the purpose by the union or an state and the condition subject to which such grant should be made, and the order appointing such commission shall define the procedure to be followed by the commission. ‘সাচার কমিশন গঠনের মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের মুসলমানরা আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে আছে তার স্বীকৃতি দিলেন। মাননীয় সাচার সাহেব তার রিপোর্টে পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, ভারতীয় মুসলমানরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনেক-অনেকটাই পিছনে। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকারের উচিত মুসলিম সংখ্যালঘু জীবনের হতাশা দূর করার সৎ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা।

১১) ‘Socially and educationally backward class’ কথাটি সংবিধানের ১৫ ধারার উল্লেখিত হয়েছে। ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘The state shall not discrimination against any citizen on grounds only of religion, race, caste, sex, place of birth or any of them’. প্রশ্ন হচ্ছে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান”-এর দেশ এই ভারতে সবার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত মানদণ্ড, কি একই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, না নেই? সেই কারণে সংযোজিত হয়েছে ১৫(৪) ধারা এবং ১৫(৫) ধারা। বলা হয়েছে, (4) Nothing in this article or in clause (2) of article 29 shall prevent the state from making any special provision for the advancement of socially and educationally backward classes of citizens or for the Scheduled Castes and Scheduled Tribes. (5) Nothing in this article or in sub-clause (g) of clause (i) of Article 19 shall prevent the state from making any special provision, by law, for the advancement of any socially and educationally backward classes of citizens or for the Scheduled Castes or the Scheduled Tribes in so far as such special provisions relate to their admission to educational institutions including private educational institutions, whether aided or un-aided by the state, other than the Minority educational institutions referred to in clause (1) of Article 30.

আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী যারা শিক্ষায় পিছিয়ে আছে এবং তপসিলী জাতি, উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে, আইন তৈরি করতে হবে। তপসিলী জাতি, উপজাতিদের জন্য সেই আইন তৈরি হয়েছে। মনোরঞ্জন সর্দারের ছেলে-মেয়েরা সেই আইনের সুযোগে জীবনে অনেকটাই এগিয়েছে কিন্তু তাদের সমগোত্রীয় কপিলদ্দী সর্দারদের জন্য কোন আইন বা সরকারি দয়া না থাকায় মুসলিম জনগোষ্ঠী পিছিয়ে ছিল পিছিয়ে আছে।

    কেন্দ্রীয় অথবা রাজ্য সরকার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে “Socially and Educationally Backward” জনগোষ্ঠী হিসাবে  চিহ্নিত করলে এই হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি সাহায্যের দরজা উন্মুক্ত হতে পারে, তারা জীবনে বাঁচার ভরসা পেতে পারে।

 

আরও পড়ুন এই লেখকের লেখাঃ সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে মুসলিমদের ব্যর্থতার কারণ

 

(লেখাটি মুন্সী আবুল কাশেম প্রণীত “৩০ ধারার ডাইরি” বই থেকে অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশ করা হল। আবুল কাসেম মুন্সী সাহেব একাধারে প্রাবন্ধিক, সমাজসেবী, আইনজীবী এবং সেই সাথে বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘শিশু বিকাশ অ্যাকাডেমির’ প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক।)

Back To Top