হিন্দুত্ববাদের আদি জনক সর্দার প্যাটেল প্রসঙ্গে

~অসিতবরণ রায়

 

২০১৪ সালের ক্ষমতায় আসার পরই নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন যে ১৯৪৭ দেশ বিভাজনের পর সর্দার প্যাটেল যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে ভারতের চেহারা অন্যরকম হত। অর্থাৎ সমাজ ও রাজনীতির সর্বস্তরে হিন্দুত্ববাদীদের প্রাধান্য চূড়ান্ত হত। সেই বিবৃতির ধারাবাহিকতায় মোদী ৩০ অক্টোবর বিপুল ব্যয়ে ৬০০ ফুট উচু একটি প্যাটেলের মূর্তি স্থাপন করেন বিরাট সমারোহে। ৭২টি  আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের ৭৫,০০০ মানুষকে উচ্ছেদ করে। তদের এই স্ট্যাচু স্থাপনা ভারতের মানুষের কাছে এই বার্তা নিয়ে আসে যে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরু আম্বেদকারকে দিয়ে ভারতের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার অংশ ঢুকিয়ে ভারতের যে সর্বনাশ করেছেন তার সংশোধন করে তুর্কী-পাঠান-মোঘল রাজত্বের ইতিহাসের চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরানো হবে। তার লক্ষণ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। মোঘলসরাই ষ্টেশন বদল হয়েছে জনসংঘ নেতা দীনদয়ালের নামে, ফৈজাবাদ হয়েছে অয্যোধ্যা, এলাহাবাদকে প্রয়াগরাজ। আরও অনেক নাম বদল হবে। এখন ভারতের আইকন হলেন বল্লভভাই প্যাটেল। প্রসঙ্গত বলে নিই, বিজেপি বাংলা ভাগের নায়ক শ্যামাপ্রসাদ, যিনি ছিলেন হিন্দু মহাসভার সভাপতি। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিন  ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পালন করার নির্দেশ দেন। এহেন শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন সর্দার প্যাটেলের স্নেহধন্য। স্বাভাবিক, কারা-কারা, মাসতুতো ভাই হয়! প্যাটেল ১৯৪৫ সালে কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে যেন কংগ্রেস প্রার্থী না দেয় এই মর্মে নির্দেশ দেন ( ট্র্যান্সফার অফ পাওয়ার , পঞ্চম খণ্ড ১২০২)। তা স্বত্বেও বাংলা কংগ্রেস শ্যামার বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয় এবঙ্গে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এতই ছিল শ্যামার জনপ্রিয়তা।

বলার কথা হল অবিভক্ত ভারতে ও বাংলায় এই দুটি ধারা কংগ্রেসের মধ্যে বরাবর ছিল। প্রথমটিতে সর্দার প্যাটেল এবং বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ। দুজনের চিন্তাধারাই ছিল হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধাচারণ করা।

এবার প্যাটেলের সঙ্গে আরএসএস যোগটা অনুসন্ধান করা যাক। সাভারকার ইংরেজের কাছে মুচলেকা দিয়ে আসাই ছাড়া পেয়েছেন। গান্ধীকে নাথুরাম গডসে হত্যা করেছে। প্যাটেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সর্বময়তার ক্ষমতা। তাই সবাই প্যাটেলের দিকে আঙ্গুল তুলছে, সেই সময় প্যাটেল আরএসএস তাত্ত্বিক সাভারকারকে লিখলেন “ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কংগ্রেসেই যোগ দিয়েই আপনার লোকেরা দেশ প্রেমের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, আমি আনন্দিত যে আপনি ভ্রাতাশ্রী মুক্তি পেয়েছেন”। এর কিছু দিন পরেই প্যাটেল আরএসএসের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন (ফ্রন্ট লাইন, ২০১৮)।

১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট প্যাটেল তার বক্তৃতায় বলেছেন হিন্দুস্তান- পাকিস্থান দুটি দেশ ভাগ করার সিদ্ধান্ত তিনি অনেক ভেবে চিন্তেই নিয়েছেন। ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গেলে পাকিস্থানকে বার করে দিতেই হত। এর দায় সম্পূর্ণ মুসলিমদের উপর বর্তাবে বলে তিনি দাবী করেছিলেন। প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারীও এই কথা বলে বিজেপির আক্রমণের মুখে পড়েছেন। কলকাতায় ১৯৪৬ সালে যে পৈশাচিক দাঙ্গা হয় তাতে ব্রিটিশ রিপোর্টে যা প্রথমে বলা হয়েছিল আক্রান্ত বেশিরভাগই মুসলিম। প্যাটেল তার চিঠিতে লিখেছেন, ( নির্বাচিত চিঠিপত্র খণ্ড ৩ পৃ ১৪৮)। কলকাতার দাঙ্গা ১৯৪৬ এ হিন্দুরা দারুন এবং সবচেয়ে ভাল ফল লাভ করেছে। এর পরই বাংলা ভাগ হল। তাই প্যাটেলকে বাংলাভাগের প্রধান নায়ক ও বলা যেতে পারে। এবং অবশ্যই তার চ্যালা  শ্যামাপ্রসাদও। বিজেপি অবশ্য তার প্রতিদানও  ক্রমাগত দিয়ে চলেছে। ৬৫০ কোটি টাকায় দিল্লিতে সেভিক সেন্টার, মুম্বাইতে তার নাম চক। রিসার্চ ফাউন্ডেশন পেল্লায় ইন্ডোর স্টেডিয়াম গোয়ায়। বাংলা ভাগের আসল জনক প্যাটেল সেটা মৌলানা আজাদের ‘ভারত ভাগ হল’ পড়লেই বোঝা যায়। দেশ ভাগের প্রকৃত বাহক , আমাদের মতে, এখন সর্দার প্যাটেল। সর্দার প্যাটেলের পরামর্শেই গান্ধীজি তাঁর অতীত ঐক্যবদ্ধ ভারতের মত পালটে ফেলেন। অজুহাত ছিল রাজনৈতিক বাস্তবতা। যখন দিল্লিতে প্রকাশ্য দিবালোকে মুসলমানরা কচুকাটা হচ্ছে, জওহরলাল গান্ধীজিকে প্যাটেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমাচ্ছেন। তখন অম্লানবদনে সর্দার প্যাটেল গান্ধীজীকে বলছেন ‘জওহরলালের এই সব অভিযোগ সম্পূর্ণ অনর্থক ও অসত্য । তাঁর কথা শুনে গান্ধীজি যে অনশনে নেমেছেন তাতে মনে হবে প্যাটেল মুসলমান হত্যার জন্য সর্দার প্যাটেলই দায়ী। গোটা দুনিয়ার সামনে তিনি হিন্দুদের মুখে চুনকালি না মাখিয়ে ছাড়বেন না’ (আজাদ, ২১৬-২১৭ পৃ)

কাশ্মীরে যেভাবে গা- জোয়ারি করে দুই- তৃতীয়াংশ অধিকার করা হল তাঁর নায়কও ছিলেন প্যাটেল। একই প্রক্রিয়ায় নৃপতি শাসিত রাজ্য গুলি বিশেষ করে হায়দ্রাবাদ দখল হল তাঁর কারিগরও ছিলেন প্যাটেল। যখন আবুল হাশেম, বাংলা লীগের সভাপতি এবং শরত বসু ও সোহরাওয়ারদি স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব, জিন্নাহ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন, তখন প্রধান বাঁধা আসে প্যাটেলের কাছ থেকে। তিনি ১৯৪৭ সালে এই বাঁধা না দিলে স্বাধীন বাংলা হতে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকত না। একই সাথে প্যাটেল তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ নির্মম ভাবে দমন করছিলেন। স্বরাস্ত্রমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর মুসলিম বিদ্বেষ এখন কিংবদন্তী। তাই আজকে মোদীজির প্যাটেল বন্দনা ও স্ট্যাচু স্থাপন করা অত্যন্ত ইহিহাস সম্মত এক আদর্শের প্রতি সহমর্মিতা। যার বিষময় ফলাফল ভারতবাসী দেখছে। হিন্দুত্বের জনক সাভারকারের সঙ্গে তাঁর নাম একই সাথে এবার থেকে উচ্চারণ হবে।

 

(লেখক একজন বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং NAPM নামে একটি সংগঠনের আহ্বায়ক। মতামত লেখকের নিজস্ব। লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে লেখকের নামের উপরে ক্লিক করুন। আপনার মতামত জানাতে পারেন কমেন্ট করে অথবা ইমেলের মাধ্যমে mydinkal@gmail.com এই ঠিকানায়।)

Back To Top