কেউ ‘কথা’ রাখেনা

~মোঃ আয়াতুল্লা খোমেনী

#মতামত

‘কথা’ই বোধহয় সবচেয়ে নির্লজ্জ,বেহায়া।

‘কথা’র বিকৃতিই সবচেয়ে বেশি। ‘কথা’ও একপ্রকার শিল্প। কথার বুননে মানুষ অপ্রীতিকর কে প্রীতিকর করে তোলে-এর দৃষ্টান্ত না দিলেও চলে। একসময় ভাবতাম রাজনীতিকে পাশ কাটিয়েও আর্থ-সামাজিক উন্নতি করা যায়। সে ভুল এখন ভেঙেছে। এখন দেখছি রাজনীতিই আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রক। অনেক বিষয়েরই দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। ডান-বাম-রাম সমস্ত দলই তার “আদর্শিক ফরম‍্যাট” কে সম্মুখে রেখে আমজনতার কাছে কতকগুলি “প্রতিশ্রুতির অবয়ব” খাড়া করে তার মাধ‍্যমে ক্ষমতার অলিন্দে বসে। ব্রিটিশ শাসনের নিকট থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর এযাবৎ যারাই আমাদের শাসন করেছে ,তারাই ‘প্রতিশ্রুতির বিকৃতি’ ঘটিয়েছে। আমাদের বাংলায় তৎকালীন কংগ্রেসের স্বৈরশাসনের অক্টোপাশ থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্য জনগণ বামপন্থী দলগুলির যৌথ ক্ষমতায়নকে সমর্থন করে। শিল্পী-সাহিত‍্যিক-সংবেদনশীল মানুষদের কলমকে বামপন্থা কাজে লাগায়। ‘গরিবের বন্ধু’ বলে প্রচার প্রসার হয়। কিন্তু দীর্ঘকালীন ক্ষমতাও তাদের অহংকারী করে তুললো। গরিবের বন্ধুরাই গরিবের পেটে ছুরি মারলো। তারাও ‘কথা’র বিকৃতি ঘটালো। স্বৈরাচারী বামপন্থীদের নাগপাশ থেকে রাজ‍্যের জনগণ শান্তিলাভের আশায় “সবুজের” ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এদের প্রতিশ্রুতি ছিলো “বদলা নয়,বদল চাই”। এই দৃঢ় ‘কথা’র উপর আস্থা রাখলো জনগণ। কিন্তু কিছুদূর শাসনের পথ চলতেই সেই প্রতিশ্রুতির বিকৃতি সাধন হলো। বাংলার উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম দেয়ালে “বদলা নয় ,বদল চাই” এই কথার প্রতিধ্বনি অতি নির্লজ্জভাবে তার মূল ‘ধ্বনি’ কে উপহাসে পর্যবসিত করলো।

কেন্দ্রীয় রাজনীতির দিকে তাকালে একই চিত্ররুপ প্রতিফলিত। কংগ্রেসের শোষন, দূর্নীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জনতা “গেরুয়াবাদীদের ” “সুশাসনের বচনের” দিকে মুখ রেখেছিলো। কিন্তু মাত্র একটি সংসদ ভোটের অবকাশে সেই জনতার মুখ তাদের কুশাসনের ঝলকানিতে ঝলসে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করলো। এখন আবার অন‍্যরা “সুশাসনের মধুর বচনের পসরা” নিয়ে হাজির।

উত্তর প্রদেশে দলিতদের অধিকার আদায়ে তাদের সংগঠিত করে মায়াবতী ‘কথা’র দ্বারা আশার আলো দেখিয়েছিলো। কিন্তু তিনিও কথা রাখেননি। ক্ষমতার মসনদে বসে তিনিও শাসন ও শোষন করেছেন। ফলত, দলিতরা তাদের জীবনচর্যায় মর্যাদা লাভ করেনি।।

আমার বাবা বামপন্থি সমর্থক ছিলেন। আমি দেখেছি -বামপন্থিরা কোনো সন্ত্রাস করলে বাবা চুপ থাকতেন কিংবা বলতেন,-‘ওটা বিরোধীদের কারসাজি’। এখন অনেকেই অন‍্যদলের নীতিহীনতার বিরুদ্ধে , সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে পথে নামেন কিংবা কলম ধরেন। কিন্তু নিজ দলের বা যে দলের সমর্থক তার নীতিহীনতা, সন্ত্রাস তাঁর নিকট ‘ মিঠে’ মনে হয়।
এটা আসলে একটি মনস্তাত্ত্বিক ব‍্যাপার। আসলে তিনি তাঁর দলের ‘কথা’র প্রতি আস্থা রেখে আশায় বুক বেঁধেছিলেন–সেই ‘কথা’র এমন বিকৃতি ঘটবে এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননা। তাই তিনি মানতেও চাননা।

আসলে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি দেশের সাধারণ জনতার সাথে কি আচরণ করে তার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হলো——
‘একজন ক্ষুধার্ত শিশুকে তার পরিবারের কিছু সদস্য কোলে নিয়ে পালা করে দোল দিতে থাকে। তখন ক্ষুধার্ত শিশুর সুকুমার দুই ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠে,সে ভাবে -এই দোলের পরেই বোধহয় তার মুখে খাদ‍্যের টুকরো ধরা হবে। কিন্তু তার বিভিন্ন জনের কোলে ‘দোল’ খাওয়াই সার হয়,ক্ষুধা আর মেটেনা। ‘

কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায়_
“আমাদের নেই কোনো ইতিহাস
আমরা ভিখারি বারোমাস।”


সাধারন মানুষকে ভিত্তি করেই নেতারা মসনদ দখলের মত্ততায় মাতে। তাদের উন্নতির কথা ভাবেনা। তাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনের তেমন পরিবর্তন ঘটেনা। দিন-মাস-বছরের পর বছর গঙ্গায় জল বয়েই চলে কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনতরী একই অবস্থানে থেকে যায়। সাধারণের উঁচিয়ে থাকা মুষ্টিবদ্ধ হাত মসনদের পরিবর্তন ঘটায় বটে, কিন্তু তাদের “দৈন‍্যতার’ পরিবর্তন ঘটায়না।

লেখক মোঃ আয়াতুল্লাহ খোমেনী বি এড কলেজের শিক্ষক এবং সেইসাথে সমাজসেবার কাজে নিজেকে উৎসর্গকারী একজন মানুষ।

Back To Top