নিয়তি – পর্ব ৮

~আসমা আক্তার পিঙ্কি

আমায় মাফ করুন আর এই খাবার আর ঔষধ খেয়ে আমায় উদ্ধার করুন……….!

নাজিফা তখন ইমাদকে বললো —- কিন্তু…..
—– কিন্তু কী, এখন কী বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো বলবেন খেতে পারবোনা, আমায় খায়িয়ে দেন।
—- তা বলবো না, তবে সত্যি আমি নিজের হাতে খেতে পারবোনা।
— ব্যাথা তো পেয়েছেন কপালে আর পায়ে, হাতে তো পাননি।তাহলে খেতে পারবেন না কেন???
নাজিফা ইমাদের প্রশ্নের কোনো উওর না দিয়ে , বালিশ থেকে কোনো মতে বসতে চাইলেই পায়ে প্রচন্ড জোরে টান খায়, কপালের আঘাতটা একটু বেশি লেগেছে যার কারনে মাথা ও বারবার ঘুরছে।
ইমাদ দূর থেকে তা দেখতে পেয়ে নাজিফার সামনে এসে বললো,—- আমায় না মেরে ছাড়বেন না।
এই বলে নাজিফাকে কোনোমতো বসিয়ে, ভাত মেখে ওর মুখের সামনে নিতেই ইমাদের হাতটা বারবার কাঁপতে লাগলো। নাজিফা তা দেখে হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, ইমাদ তখন বললো — এমন হা করে তাকানোর কী আছে?????
— না মানি আপনি আমাকে সামান্য দুটো ভাত খাওয়াতে গিয়ে আপনার হাত কাপঁছে???
—- না কাঁপবে কেন? আমি তো মেয়ে আমার দশ- বারটা বাচ্চা আছে, প্রতিদিন ওদের খায়িয়ে– দিতে- দিতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে । যতসব, নিন খান।
নাজিফা আর কোনো কথা না বলে
ইমাদের হাত থেকে খাবারটা মুখে নিলো। পৃথিবীর সব সুখ যেনো আজ ওর পায়ের নিচে লুটোপুটি খাচ্ছে। বাকা চাঁদটা ও যেনো তা দেখে হাসছে, আর সুখ নামের নৌকায় উঠতে পেরে মেয়েটির চোখে আজ ওও অশ্রুকণার ছোয়া দেখা যাচ্ছে।

ইমাদ তা দেখে বললো — এ কী নাকের জল আর চোখের জল এক করেছেন কেন? তরকারীতে কী জাল হয়েছে বেশি?
নাজিফা মাথা নেড়ে বললো — না।
— তাহলে আপনার কী সবসময় কান্না করা একটা রোগ হয়ে গেছে।
নাজিফা ইমাদের কথায় ঠোঁটের কোনে মলিন হাসি ফুটিয়ে বললো —- কেউ এভাবে খায়িয়ে দেয়নি তো কখনো, তাই আনন্দে চোখে জল চলে এসেছে।
নাজিফার কথায় ইমাদ অনেকক্ষণ ওর দিকে চেয়ে থাকে, মেয়েটি বড়ই অদ্ভুত, একটা মায়াজালে আমায় বেধে ফেলছে, কিন্তু এই মায়াজালে যে আমি আর পড়তে চাইনা। নিজের আবেগটাকে লুকানোর জন্য ইমাদ অট্টহেসে বলতে লাগলো — ছোট বেলায় মা কখনো খায়িয়ে দেয়নি।
নাজিফা কথাটির কোনো উওরেই দিলোনা, কেবল নিশ্চুপ ভাবে বসে চোখের জলেই ফেললো। ইমাদ তখন পকেট থেকে রুমাল বের করে নাজিফাকে দিয়ে বললো — এই সস্তা চোখের পানি গুলো মুছুন।
নাজিফা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই ইমাদ বললো — যে কথায়- কথায় চোখের জল ফেলে তার চোখের জল সস্তা ছাড়া আর কিছুই নয়।

ইমাদ এই বলে ওয়াশরুমে যায় হাত ধুতে। এসে দেখে নাজিফা রুমালটা নিয়ে সমানে নিজের নাক মুছছে। ইমাদ রেগে গিয়ে নাজিফাকে বলে —ইয়াক, এই রুমালটা আমি কী করে ইউজ করবো, ছিঃ, ছিঃ, এই ভাবে তো বাচ্চারা ও করেনা।
—- স্যরি, এই বলে নাজিফা মাথা নিচু করে ইমাদকে রুমালটা দিতেই ইমাদ বলে-উঠলো—- আমি তো পাগল এই নোংরা রুমালটা আমি এখন নিবো।
— যাক বাবা আপনি তো আপনার এই রুমালের জন্য আমায় বকছেন, এই নেন আমার আর লাগবেনা।
— লাগবে কেমনে চোখের জলের সাথে নাকের জল ও মুছে ফেলছেন, এখন আর এটা কী আপনার লাগবে? গাধী একটা ওটা ফেলে দিন। এই নিন ঔষধ খান।

—- আচ্ছা ঔষধ তো খেলাম এবার আমি কী যেতে পারি, না মানে আপনার রুমে তো আর বেশিসময় থাকা উচিত নয়, এবার আমি বরং মায়ের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি ।
—– কী ঢং দেখাচ্ছে, এই যে এই মচকানো পা নিয়ে দু সপ্তাহ এই বিছানা থেকে উঠতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে, আর ওনি যাই – যাই করে, যতসব।
— আপনি কথায় – কথায় এমন ঝগড়া করেন কেন?
— কী আমি ঝগড়া করি, ভালো উঠতে পারেন কিনা দেখুন তো?
—- না উঠতে পারলে কী আর করবো এখানেই ঘুমাবো।
— এর জন্য ই তো পড়েছেন, আমার এখন মনে হচ্ছে আপনি ইচ্ছে করেই পড়েছেন, ঘর থেকে বের করে দিয়েছি বলে সেই প্রতিশোধ নিতে এমন করেছেন।
নিন ঘুমান।
—- আপনি কোথায় ঘুমাবেন?
— সেই চিন্তা আপনাকে করতে হবেনা।
ছেলেটি কথায়- কথায় রাগ দেখায়। তবে এই রাগের ভিতরে ওর অনুরাগ টা লুকিয়ে রয়েছে, যা যে কাউকে আপন করতে দ্বিধা বোধ ও করেনা।

ইমাদ ঘরের আলো অফ করে দেয়, হালকা ডিম লাইটের আলোয় সোফায় শুয়ে বাহিরের পাণে চেয়ে থাকে। নাজিফা ঘুমিয়ে পড়ে। নিঃশব্দ পরিবেশ, নিশ্চুপ চারপাশ, বাহিরে হঠ্যাৎ বৃষ্টি, কিচিরমিচির আর গুনগুনানি শব্দ, হঠ্যাৎ করে মেঘের গুড়ুম – গুড়ুক ডাক, জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানির হালকা স্পর্শ আর মৃদু বাতাসে ঠান্ডা অনুভূতি হওয়ায় ইমাদ জানালা লাগাতে বিছানার সামনে যেতেই চোখ পড়ে নাজিফার মুখ পানে মায়ারঘোরে হারিয়ে যায় ছেলেটি, একটা অজানা,অচেনা মায়া তাকে স্পর্শ করছে, অজানা এক অনুভূতিতে বারবার শরীর শিহরিয়ে উঠছে।
ঘোমটার আড়ালে এতদিন যে মেয়েটিকে সে লুকিয়ে থাকতে বলেছে আজ তার মুখ খানা দেখতে পেয়ে ইমাদের মনো হলো রাত্রির আকাশে এ যেনো এক সুখ তারা যে নিজের আলো দিয়ে পুরো আকাশটাকে দীপ্তময় করে রেখেছে। তার চেহারাটা এতোটা মলিন আর মায়াবী যে, যে কেউই ওই মুখের দিকে তাকিয়ে শত প্রহর কাটিয়ে দিতে পারে। কাঁচা হলদের ন্যায় গায়ের রং, মনে হয় যেনো নূর ঝরছে, ওর চলার গতি সহজ,দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব।
এক কথায় সে যে গাছে ফুটেছে তাকে অতিক্রম করে রজনীগন্ধার শুভ্র মঞ্জরীর মতো সরল বৃন্তটির উপর দাড়িয়ে রয়েছে।
ওর উপমা ওই, ইমাদ যে কখন এসব ভাবতে- ভাবতে নাজিফার পাশে চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতেই পারেনি।

ফজরে আজান কানে যেতেই নাজিফার ঘুম ভেঙ্গে যায়, চোখ মেলে দেখে ইমাদ ওর পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। নাজিফা ওর দিকে চেয়ে অসহায়ভাবে বলতে লাগলো —- আল্লাহ আমার জন্য রাতে ওনি ঠিক করে ঘুমোতে পারলোনা। আল্লাহ তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেও, যাতে আমি এই ঘর থেকে তাড়াতাড়ি যেতে পারি। যাই নামাজ টা পড়ে নেই। এই বলে নাজিফা নিচে পা রাখতেই ব্যাথায় জোরে চিৎকার দেয়। ওর চিৎকার শুনে ইমাদ চোখ খুলতেই ওকে এই অবস্থায় দেখে প্রচন্ড জোরে একটা ধমক দিয়ে বললো — এতো বেশি বুঝেন কেন, এই অবস্থায় কোথায় যাচ্ছিলেন?
— না মানে অযু করতে।
— তো আমাকে ডাকলেই তো পারতেন। আর এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে কী হয়না??????আপনার যে অবস্থা তাতে আপনি নামাজ পড়বেন কী করে?
—- অসুস্থ বলে তো খাওয়া– দাওয়া,,আরাম- আয়েশ ছেড়ে দিচ্ছিনা, তাহলে নামাজ কেন ছেড়ে দিবো??
—– আল্লাহ যদি এতোই ভালোবাসে আপনাকে তাহলে কষ্ট দিচ্ছে কেন???
—– মা- বাবা আমাদের ভালোবাসে বলেই যে আমাদের সব আবদার মিটায় এমন নয়, ঠিক তেমনি আল্লাহ আমাদের ভালোবাসে বলে যে অসুখ, সমস্যা দিবেনা এমন নয়, বরং আর ও বেশি করে তিনি তার প্রিয় বান্দাদেরকে সমস্যা দেয়,যাতে তারা সেই সমস্যার মাঝে ও তাকে স্মরন করে কিনা তা পরীক্ষা করে।
ইমাদ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বালতিতে করে অযুর পানি নিয়ে এসে নাজিফার সামনে দিয়ে বলে—- নিন সকাল-সকাল আমাকে কষ্ট না দিয়ে তো ছাড়বেননা।
—- আমি তো আপনাকে কষ্ট দিতে চায়নি, আপনি নিজেই তো পানি আনতে গিয়েছেন, আমি তো উঠে গিয়েই ওয়াশরুমে অযু করে আসতাম।
—- চুপ থাকুন উঠে গিয়ে অযু করতে আসতেন , হাঁটতে পারতেন যে অযু করতেন।

নাজিফা অযু করতে লাগলো, ইমাদ সেই সৌন্দর্য এক দৃষ্টিতে অবলোকন করতে থাকে । ওর পানে চেয়ে থেকে ইমাদ কল্পনার রাজ্য বিভর হলো।
—- এই যে এভাবে কী দেখছেন???
নাজিফার কথায় ইমাদ কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতায় ফিরলো, একটু সংকোচ নিয়ে বলল——Nothing, আপনি এখন কীভাবে নামাজ পড়বেন, আপনি তো দাঁড়াতে পারবেননা।
— আল্লাহ আমাদের জন্য সবকিছু সহজ করে দিয়েছেন, অসুস্থ অবস্থায় আমরা,বসে, শুয়ে এবং ইশারা দিয়ে ও নামাজ পড়তে পারি।
—- ওকে তাহলে আপনি পড়ুন আমি আসছি।
—- কোথায় যাচ্ছেন????

নাজিফার প্রশ্নটায় ইমাদ নাজিফার দিকে তাকাতেই নাজিফা বলতে লাগলো — না মানে এতো সকাল– সকাল বাহিরে যাচ্ছেন তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আর তাছাড়া আপনি নামাজ পড়বেন না???
— যিনি আমার স্ত্রী কে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছেন তিনি কখনোই আমাকে ভালোবাসতে পারেনা, সুতারং আমি আসছি।
ছেলেটা এখন ও নিজের কাছের মানুষের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছেনা। কিন্তু কেন সে বুঝছেনা, একদিন আমাদের সকলকে তার কাছে চলে যেতে হয় আর এটাই নিয়ম, কেউ হয়তো দুদিন আগে যায়, কেউ হয়তো দুদিন পরে । নাজিফা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, নামাজে মগ্ন হলো।

সকাল আটটায় নাবা ইমাদের রুমে আসে, নাজিফা তখন ঘুমাচ্ছিলো । নাবা ওর মাথার পাশে বসে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো —- মা ও মা।
নাবার আলতো ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শে নাজিফার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মায়া মাখা মুখখানি দেখতে পেয়ে নাজিফা একটু উঠে বসে নাবাকে আদর করে বললো — নাবা তুমি এখানে?
—- মা তুমি ভাদো আতো?
— হ্যা তো মা এইযে ভালো আছি ।
—- মা,মা, আপু, আপু ইততে কতে কদেনি, ফুপি — ফুপি বদেছে, তোমাকে ব্যাতা দিতে।
নাজিফা নাবার আদৌ- আদৌ মুখের বাণী শুনে বুঝলো, সব ঘটনা। নিশ্চুপ হয়ে গেলো। নিতুকে বাহিরে যেতে দেয়নি বলে ও এভাবে নওরীনকে ব্যাবহার করে আমাকে………….
এমন সময় ইমাদ রুমে আসে, নাবাকে দেখে বলে — আম্ম ু তুমি এখানে।
—- বাবাই দানো, বোন আম্মুকে……
অমনেই নাজিফা নাবার মুখ চেপে ধরলো।
ইমাদ তা দেখে বললো — ওর মুখ চেপে ধরলেন কেন???
ও কী বলতে চেয়েছি???
—- কিছুনা, আসলে এমনেই।
ইমাদ নাবার কাছে এসে নাজিফার হাতটি সরিয়ে বললো………!!!

 

 

 

নবম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

চতুর্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

পঞ্চম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

ষষ্ঠ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

সপ্তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

Back To Top