খিলাফত-সৈনিক মওলানা রফিকুল হাসানঃ মওলানা আজাদের স্নেহধন্য


  ~মোহাম্মদ সাদউদ্দিন~

*মাত্র ২০-২১ বছর বয়স থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য নানান কার্যকলাপ সংগঠিত করেন বাংলার মাটিতে। আর তার সেই ঐতিহাসিক কাজকর্মে যিনি অনুপ্রেরক ছিলেন তিনি হলেন আরেক স্বাধীনতা সংগ্রামী মওলানা আবুল কালাম আজাদ। তার স্নেহধন্য ছিলেন মওলানা রফিকুল হাসান। অথচ তার ইতিহাস যেন আজ মৃতপ্রায়। বিভাগ পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮- ১৯৭৮ পর্যন্ত এক নাগাড়ে ‘কোরআন প্রচার’ পত্রিকা বের করে ইসলামিক দর্শন ও ইসলামিক মতবাদ মানুষের সামনে তুলে ধরেন। অথচ এই ব্যক্তিত্ব মওলানা আবুল কালাম আজাদের একজন স্নেহধন্য হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী হিসাবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। দেশভাগের পর মওলানা রফিকুল হাসান তৎকালীন বাংলা তথা ভারতের সুপ্রসিদ্ধ সুফি সাধক পীর আল্লামা রুহুল আমিন (র) সম্পাদিত মাসিক ‘সুন্নাত আল জামাত’ পত্রিকার ম্যানেজার হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে এই পত্রিকার কিছুদিন সম্পাদনার দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। আল্লামা পীর রুহুল আমিন(রহ)-এর মৃত্যুর পর মওলানা রফিকুল হাসান মাসিক ‘সুন্নাত আল জামাত’ প্রেস কিনে নেন। পরবর্তীকালে এই প্রেস থেকেই ‘কোরআন প্রচার’ প্রচার পত্রিকা প্রকাশ করেন।

১৯৪৮ সাল থেকে মধ্য কলকাতার নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর কাছে ম্যাকলিয়েড স্ট্রিটে এখনও সেই প্রেস রয়েছে যেটি তার ছোট ছেলে চালান। আর তার মধ্যম ছেলে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের স্নেহধন্য সফিকুর রহমান এখনও মাঝে মাঝে ‘কোরআন প্রচার’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের করেন। মওলানা রফিকুল হাসানের বড় কৃতিত্ব হল তিনি ‘কোরআন প্রচার’ পত্রিকার মাধ্যমে ‘আল কোরআনের’ তফসির ও তরজমা ধারাবাহিক প্রচার করেন। একইভাবে তিনি পৃথক ভাবে বই আকারে দুই পারার বাংলা তফসির কোরআনও প্রকাশ করেন। আল কোরআন তথা আরবি ভাষাকে বোঝার জন্য। তিনি রচনা করেন ‘আরবি-বাংলা-অভিধান’ যা তার জীবনে একটি ঐতিহাসিক কৃতিত্ব। এবারে মওলানা রফিকুল হাসানের ব্যক্তি পরিচয় পর্বটিতে আসা যাক । দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর থানার আমতলা সংলগ্ন ( ডায়মন্ড হারবার রোড) চক এনায়েতনগর গ্রামে ১৯০৩ সালে মওলানা রফিকুল হাসানের জন্ম । পিতার নাম মুন্সী মতিউল্লাহ । আর মায়ের নাম এসারন বিবি। মুন্সী মতিউল্লার দুই পুত্র ও তিন কন্যা ।

অভিজাত পরিবারের সন্তান রফিকুল হাসানের বাল্যশিক্ষা হয় গৃহপরিবেশে ও গ্রামের পাঠশালায় । এর পর উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন এশিয়ার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলকাতা মাদ্রাসা কলেজ ( মাদ্রাসা আলিয়াও বলা হত) । বর্তমানে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী ও উত্তাল অবস্থায় তিনি কলকাতা মাদ্রাসা কলেজে তার ছাত্রজীবন সমাপ্ত করেন। অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কলকাতা মাদ্রাসা কলেজের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ‘জামাতে উলা’ লাভ করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত খিলাফত আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে খিলাফত ওসমানিয়াকে তুরস্ক থেকে উৎখাত করা হয়। আর তৈরি হয় জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র। গোটা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায় প্রতিবাদে গর্জে উঠে। ব্রিটিশ ভারতেও মুসলিম নেতৃবৃন্দ ‘খিলাফত কমিটি’ গড়ে খিলাফত আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। মাল্টার জেলে বন্দী শাইখুল হিন্দ ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী হজরত শাইখুল হিন্দের আহ্বানে জাতীয় কংগ্রেসকে খিলাফত আন্দোলনে যুক্ত করেন।খিলাফত আন্দোলনের প্রবাহে উত্তাল হয়ে উঠে ভারত। আর এই যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তরুণ মওলানা রফিকুল হাসান আরেক এক জাতীয়তাবাদী নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যুক্ত হন। খিলাফত আন্দোলন, জামায়াতে ওলামায়ে হিন্দ ও জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে তিনি লিপ্ত হন। জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মওলানা রফিকুল হাসানের পরিচয়ও গড়ে উঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ‘৪২-এর ভারতছাড় আন্দোলন । আগস্ট বিপ্লব ভারতের আকাশ-বাতাস কাঁপাচ্ছে । আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। মওলানা রফিকুল হাসান যেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এক টগবগে যুবক। স্বাধীনতা আন্দোলন যখন ক্রমশ টগবগ করে ফুটছে, সে সময় ব্রিটিশ সরকার হাজির করল ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ । ভাগ হল ভারত। ভাগ হল বাংলা।জাতীয়তাবাদে নিবেদিতপ্রাণ মওলানা রফিকুল হাসান বিভাগোত্তর বাংলার মজলুম মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এই যুগসন্ধিক্ষণে তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ , হজরত মওলানা আবু তাহের (র) , হজরত মওলানা বজলুর রহমান দরগাহপুরী (র), হজরত মওলানা সৈয়দ আসাদ মাদানি (রহ), অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি, অধ্যাপক মাখনলাল রায় চৌধুরী, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, অধ্যাপক হুমায়ন কবির , ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ , অধ্যাপক মহম্মদ রাহাতুল্লাহ, মহম্মদ ইসহাক , কাজী আব্দুল গফফার প্রমুখদের সঙ্গে পরিচিত হন। একদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, অন্যদিকে লেখনি চালনা, একদিকে মজলুম মানুষের সেবা, অন্যদিকে ইসলামের শান্তি, মৈত্রী-প্রেম, ভালবাসা ও দেশপ্রেমের বার্তা পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর হন রফিকুল হাসান। ‘কোরআন প্রচার’ পত্রিকা প্রকাশ তার সাধনারই ফসল। দেশ ভাগের পর পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ , মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও অভিজাত বাঙালী মুসলিম পাড়ি দেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে। ফলে মুসলিম সমাজের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। দেশ ভাগের আগে কলকাতা থেকে পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রে ‘দৈনিক আজাদ’ মাসিক ‘মোহাম্মদী’ ‘সওগাত’ প্রভৃতি পত্রিকা বের হত। আর ধর্মীয় পত্রিকা হিসাবে আল্লামা রুহুল আমিনের সম্পাদিত মাসিক ‘সুন্নাত আল জামাত’ পত্রিকাটিও ছিল খুবই জনপ্রিয়। দেশ ভাগ জনিত কারণে দৈনিক আজাদ, মোহম্মদী , সওগাত, ঢাকায় পাড়ি দেয়। আবার মওলানা রুহুল আমিনের মৃত্যুর পর ‘সুন্নাত আল জামাত’ বন্ধ হয়ে যায়।

বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলায় কয়েক বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মুসলিম সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। কেননা পরিকল্পিত দাঙ্গা থেকে বাঁচতে বাঙালী মুসলিমরা পাড়ি দেয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে। সেই রকম সঙ্কটময় সময়ে দেশ প্রেমে অটল থেকেই মওলানা হাসান পশ্চিম বাংলায় থেকে যান। আর ১৯৪৮ সালে মধ্য কলকাতার ম্যাকলিয়েড স্ট্রিট থেকে বের করেন ‘কোরআন প্রচার’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা। উল্লেখ্য, ১৪ নং ম্যাকলিয়েড স্ট্রিট থেকে বের হত স্বাধীনতা সংগ্রামী মওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ আল হিলাল’ পত্রিকা।আর মওলানা রফিকুল হাসান ছিলেন তারও গুণমুগ্ধ ও স্নেহধন্য । ‘আল হিলাল’ পত্রিকা ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গণজাগরণের গণকণ্ঠ। মওলানা আবুল কালামের মতো নির্লোভ, সৎ , কর্মবীর ভারতীয় রাজনীতিতে হাতেগোনা। আর সেই রকম একজন ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসা মওলানা রফিকুল হাসান কোন বৈশিষ্ট্যের  হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাই ‘কোরআন প্রচার’ আর মওলানা রফিকুল হাসান এক সময় বাংলার মানুষের কাছে সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৪ ‘কাফেলা’ ও ‘নতুন গতি’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবুল আজিজ আল আমান (কাফেলা এখন বন্ধ, ‘নতুন গতি’ এমদাদুল হক নূর-এর সম্পাদনায় তালতলা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়) মওলানা রফিকুল হাসান কে ‘রাসুলুল্লাহ’ পুরষ্কার প্রদানে প্রস্তাব দেন। প্রথম পুরষ্কার দেওয়া হয় মওলানা আবু তাহেরকে। ‘কাফেলা’-র পক্ষ থেকে এই পুরষ্কার নেওয়ার কথা এলে প্রথমে রফিকুল হাসান এই পুরষ্কার নিতে অস্বীকার করেন। পরে অনেক অনুরোধের পর তিনি এই পুরষ্কার নেন। ১৯৮৫ সালে কলকাতার ‘মুসলিম ইন্সটিটিউট হল’-এ তাকে ‘রাসুলুল্লাহ’ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। আজকের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে  নেমে এসেছে চরম অবক্ষয়। ব্যক্তিগত জীবনে যে সমস্ত ব্যক্তি ইমান ও আমলের সঙ্গে সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ও নির্লোভ জীবনযাপন করে জাতি , ধর্ম ও দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, মওলানা রফিকুল হাসান তাদেরই অন্যতম। তাঁকে যেকোনও ভাবে অনুসরণ করা যায়। তিনি এক অবক্ষয়ী যুগে আমাদের কাছে অনুসরণীয় , অনুকরণীয় ও চিরস্মরণীয় । ১৯৮৬ সালের ৩০শে জানুয়ারী অসুস্থ হয়ে এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।

Back To Top