২৭ নভেম্বর সকাল বেলায় মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরের (ওমরপুর) তালাইয়ে গাইডেন্স অ্যাকাডেমির ক্যাম্পাসে তাদের নিজস্ব গেস্ট হাউসে পর পর কয়েকটি বাংলা ও হিন্দী গান শুনলাম মহম্মদ আজীজের (মুন্না)। ঠিক ঐ দিনই ফেসবুকে বন্ধু ও সাংবাদিক কিংশুক ভট্টাচার্য এর পোস্টে জানতে পারলাম আজীজ সাহেব মারা গেছেন। আরো বিস্তারিত জানলাম আরেক বন্ধু সাংবাদিক সাকিল আহমেদের পোস্টেও। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আজীজ বা মুন্না সম্পর্কে বলতে গেলে ফিরে যেতে হয় ৩৩ বছর আগে।
১৯৮৩ সাল। আমি তখন মুর্শিদাবাদের কান্দী রাজ কলেজে পড়ি। বহরমপুরে মিনহাজউদ্দিন ওরফে মিরাজ কুমার রফি কন্ঠে গান করতেন।
কান্দীতে আমার মামা বনু খানের (সফিউল খান) কান্দির থানা মোড়ে (মুর্শিদাবাদ) ‘একঝাক পায়রা’ নামে একটা অর্কেস্ট্রা ছিল সেখানে মিরাজ কুমার আসতেন। কলকাতার নানান বারে তিনি গান করতেন। বনু মামার কাছে মুন্না বা আজীজ সম্পর্কে অনেক কিছু বলতেন। তারপর বনু মামার সঙ্গেই বহরমপুরে একটি হোটেলে আজীজ ও মিরাজ কুমারের একটি গানের অনুষ্ঠানে যায়। তখনই বনু মামাকে মুন্নার অদূর ভবিষ্যৎ যে খুব ভালো সে বলেছিলাম। ঠিক ১৯৮৫ সালে হিন্দি ছবি ‘মর্দ’-এ তাঁর কন্ঠ ভেসে এলো। ‘মর্দ টাঙ্গে ওয়ালা মে হু, মর্দ টাঙ্গেবালে’ গানটি। তারপর আর মুন্না কে থেমে থাকতে হয়নি। অবশ্য মহম্মদ রফির মৃত্যুর পর বেতাব, কুলি, তেরে মেহেরবানিয়া, প্যায়ার ঝুকতা নেহি’ প্রভৃতি হিন্দি ছবিতে সাব্বির কুমার রফি সাহেবের জায়গাটা কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেন। ১৯৮৫ সালের পর সাব্বির কুমার ও মহম্মদ আজীজ অনেকটাই দখল করে নেন।
কিন্তু, মহম্মদ আজীজ একজন কণ্ঠ শিল্পী হিসেবে ভালো তো বটেই। মানুষ আজীজ ছিলেন বিনয়ী, ভদ্র ও নম্র। কণ্ঠ দিয়ে তিনি মানুষকে বশ করার পাশাপাশি তাঁর সুমিষ্ট ভাষা ও মধুর ব্যবহার দিয়ে বশ করতে পারতেন। ১৯৮৯ সাল, বীরভুমের সাইথিয়া অভেদানন্দ মহাবিদ্যালিয়ের ছাত্র আমি। সাইথিয়ার কয়েকটি ক্লাব সেখানকার নেতাজী ময়দানে মহম্মদ আজীজকে আনে। সেদিন আমরা আজীজ নাইট দেখতে যায়। এরপরও সিউড়ি, রামপুরহাট, মুর্শিদাবাদের সালারে আজীজ আসেন। সাইথিয়া অনুষ্ঠানের আয়োজকদের মধ্যে কয়েকজন আমার বন্ধুও ছিল আর তাদের সৌজন্যে আজীজকে খুব কাছ থেকে পেয়েছিলাম। আজীজ সেদিন অকপটেই বলেছিলেন কলকাতার সাকী বারের ওয়েটার থেকে সিংগার হওয়ার কাহিনী। ভুলে যাননি উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরের গ্রামের কথা। যেখানে তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন। অকপটেই বলে ফেলেন অশোকনগর থেকে খিদিরপুর আসার কথা। বারের ওয়েটার থাকতে থাকতে রফি ভক্ত। তার পরে বারের সিংগার, সেখান থেকে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ফাংশন করতে করতেই রবীন্দ্রনাথ জৈব ও অনুমালিকের কাছাকাছি হওয়া। আমরা তাঁর গাওয়া কয়েকটি বাংলা গান আজও ভুলতে পারিনা। বাংলা ‘পৃথিবী হারিয়ে গেল মরু সাহারায়’ ‘লাল শাড়ি লাল টিপ’ ‘তোমার চোখে দেখেছি যে মায়ের স্নেহ ছায়া’ ‘তোমার ঐ চোখে কত ভবের এই খেলা’ গানগুলি আজও টানে। তাঁর কন্ঠের নজরুলগীতি আজও মধুরও বাঁশরী বাজে, মুসাফির মুছরে আখি জল, ফিরে চল আপনারে নিয়া। আর অজস্র হিন্দি গান গেয়ে মানুষকে কাঁদিয়েছেন। আবার হাসিয়েছেন। ‘হর করম আপনা করেঙ্গে, ইয়ে ওয়াতন তেরে লিয়ে’, মিতুয়া ভুলই না জানা’, তুনে রঘোমে ইতনা জ্যাদা কিয়া’, পরওয়ার দিগারে আলম’ আজও ঘরে ঘরে বাজে। সাইথিয়ার যে ক্লাবে বসে ছাত্রজীবনে লেখা-লেখীর সুবাদে তাঁর মুখোমুখি হতে পেরেছিলাম, আজও তা বিস্ময় লাগে। অনেক মানুষ বড় হয়ে গেলে অতীতকে ভুলে যায়, কিন্তু না আজীজ অতীত কে ভুলে যাননি। কলকাতায় এলে অশোকনগরের গ্রামের বাড়িতে ছুটে যেতেন। অজস্র রফি ভক্তদের বাড়ী যেতেন, অজস্র মানুষের সাথে দেখা করতেন।
সাকী বারের ওয়েটার থেকে মুম্বাই বা বলিউডের সফল কন্ঠশিল্পী। অথচ মানুষ হিসেবে আজীজ বিনয়ী, নম্র, ভদ্র ও হাস্যমুখী। এই শিল্পীর অকাল প্রয়াণে আমরা হারালাম সঙ্গীত জীবনের এক নক্ষত্রকে। তাঁর ইচ্ছা মোতাবেক আরেক প্রয়াত কিংবদন্তী শিল্পী মহম্মদ রফির পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। গুরুর পাশেই শিষ্যর কবর। ধন্য গুরু, ধন্য শিষ্য।