রক্তাক্ত ঊনিশে মে : বাংলা ভাষা মুক্তির গৌরব অধ্যায়-2

মহম্মদ রাকিবুল আহমেদ…

পূর্ব প্রকাশের পর……

 

অন্যদিকে দলীয় চাপ অনোন্যপায় চালিহা ১৯৬০ সালের ২৩ জুন বাধ্য হয়েই বিধানসভায় ঘোষণা করলেন সরকার শীঘ্রই এ বিষয়ে বিল আনছেন।

হিংসার লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছে গৌহাটিতে, গোরেশ্বরে। একটা ভয়ঙ্কার কালো আকাশ বাঘের মত থাবা উঁচিয়ে বসে আছে বাঙালি নিধন যজ্ঞে, তাই- ‘পুন্যবেদীর শূন্যভেদিয়া , ক্রন্দন উঠিতেছে শুধু’ – ২ জুলাই। শিলচরে ডাকা হয়েছে ‘নিখিল আসাম বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সম্মেলন’। আসামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিধিরা এলেন। বাঙালি, খাসি, লুসাই, গারো, মনিপুরি সবাই। ভাষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কথা বলা হল। কেন্দ্রর কাছে প্রার্থনা করা হল- হস্তক্ষেপ করুন।

৪ জুলাই। অসমিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বাঙালি বিদ্বেষ চরমে উঠলো। শুরু হল বিভীষিকার বিভৎস তাণ্ডব। সারা ব্রহ্মপুত্র উপত্যাকা জুড়ে হিংসার আগুন ফেটে পড়ল। হাজার হাজার বাঙালি বাড়ি পুড়ে ছারখার। আক্রান্ত হলেন গৌহাটির বাঙালি ডেপুটি কমিশনার। বাঙালিরা দলে দলে পালিয়ে গেল শিলচর, জলপাইগুড়ি, কলকাতা। দাবি উঠলো রাষ্ট্রপতি শাসনের, কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের। ১৯৬০ সালের ১৫-ই আগস্টের স্বাধীনতা দিবস কুৎসিত বিভৎসতার উপর ধিক্কার হেনে ম্লান হয়ে রইল এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহওহরলাল নেহেরুর শান্তি দৌত্যও ব্যর্থ হল? দরবার করলো প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। দিল্লী নির্বিকার। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর অনঅসমিয়া  জনসাধারণের প্রবল বাধা উপেক্ষা করে আসাম বিধানসভায় পাশ হয়েগেল রাজ্য ভাষা বিল। নতুন আইনের বিধানে সমগ্র আসামের একমেব দ্বিতীয়ম্ সরকারি ভাষা অসমিয়া, কাছাড়ের জন্য জেলাস্তরে রইলো বাংলা ভাষা। কাছাড় সমবেত কণ্ঠে রাজ্যভাষা বিলের প্রতিবাদ জানাল।

১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারী শীতলভদ্র যাজীর সভাপতিত্বে করিমগঞ্জ শহরে ডাকা হল সম্মেলন। কাছাড়ের পল্লিতে পল্লিতে জ্বলে উঠলো বিক্ষোভের অগ্নি শিখা। হিন্দু মুসলমান এক নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হল ‘জান দেব, জবান দেব না’

শেষ সংগ্রামের প্রস্তুতি ৫ ফেব্রুয়ারী, আবার সম্মেলন ডাকা হল করিমগঞ্জে। সভাপতি তরুণ কংগ্রেস নেতা আব্দুর রহমান চৌধুরী। ১৩ এপ্রিলের মধ্যে আসাম সরকারের কাছে শেষ জবাব চাই। আসাম দেখিয়ে দেবে বাঙালিরা মরেনি, ঘুমিয়ে নেই, তারা প্রিয়তম ভাষার জন্যও প্রান দিতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যেমন প্রাণ দিয়েছিল।

তবু শেষ চেষ্টা ৫ ও ৬ নভেম্বর নওগাঁর হোজাইয়ে বাঙালিদের এক সমিতি গঠিত হয়েছিল ‘নিখিল আসাম বঙ্গভাষা সমিতি’। তাদেরই প্রতিনিধি দল ৫ এপ্রিল দিল্লি গেলেন, সংবিধানের ৩৪৭ নং ধারাবলে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দানের প্রার্থনা নিয়ে। কিন্তু প্রার্থনা বিফল হল।

এদিকে পেরিয়ে গেল ১৩ এপ্রিলের শেষ মেয়াদ। জেদী আসাম সরকার নিরুত্তর। কাছাড়ের ঘরে ঘরে দুন্দুভি বেজে উঠলো। ১ লা বৈশাখী নববর্ষের শুভদিনে সমগ্র কাছাড় শপথ নিল –‘জান দেব, জবান দেবনা’। দলে দলে বেরিয়ে পড়লো পদযাত্রী। গ্রাম থেকে গ্রামে , আর মুখে গানের কলি, মোদের গরব মোদের আশা, আ–মরি বাংলা ভাষা’। চাষি, জেলে, তাঁতি, স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের আসন্ন আন্দোলনের পুলকে কেঁপে কেঁপে উঠে বড়থল, দেওয়ান, দার্বি, আয়নাখাল সকল চা-বাগানে, শ্রীগৌরী, মাছালী, কায়স্থগ্রাম, উদরবন্দ সকল গ্রামে, বদরপুর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, শিলচর সকল শহরে বিপুল উম্মাদনা যেন গনঅভ্যুত্থান। সত্যাগ্রাহী দলে নাম লেখানোর জন্য সংগ্রাম পরিষদের শাখায় শাখায় ভিড়। হাজার, দশ হাজার ক্রমেই বেড়ে চলে –‘বাংলা ভাষার রাখিতে মান, জীবন দানিতে হও আগুয়ান’।

চলছে হাটে-বাজারে-মোড়ে মোড়ে পথসভা। পূর্ণ মে মাস হতে চললো অহিংসা সত্যাগ্রহের প্রস্তুতি। প্রত্যেকটি মানুষের হাতে সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা শ্রী রবীন্দ্রনাথ সেনের নামাঙ্কিত ইস্তাহার। অভূতপূর্ব উম্মাদনার মধ্যে ঘোষণা করা হল সেই ঐতিহাসিক তারিখ ১৯ মে। ১৯ মে শিলচর পৌরসভার চেয়ারম্যান শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ ডাকলেন এক জরুরী সভা। সেই সভায় পৌরোহিত্য শ্রীযুক্ত জ্যোৎস্না চন্দ্র। বিখ্যাত পরিবারের কূলবধূ। ভাষা আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে যাওয়ার আবেদন জানালেন। এদিকে আসাম সরকারও উদাসীন নয়। শক্তির মত্ততা দেখাতে তারা জেলায় ছেড়ে দিলেন ব্যাটেলিয়ান সৈন্য, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট, আসাম রাইফেল, সেন্টাল রিজার্ভ ফোর্স। বিশেষ ভারপ্রাপ্ত হয়ে আসলেন ডি.আই.জি. লালা, বিমলেন্দু কুমার দে এবং কমিশনার বি.এল. সেন। পথে পথে মিলিটারি গাড়ি, টহলদারি সিপাই, তদুপরি ১৪৪ ধারার সন্ত্রাস সংগ্রামী জনতার তবু দমলো না। অকুতভয়ে গান ধরলো নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন হবেই হবে। যদি পণ করেই থাকি, সে পণ তোমার রবেই রবে

১৮ মে বৃহস্পতিবার। কাছাড়ের বাঙালিদের সারারাত চোখে ঘুম নেই। সূর্য উঠবে কখন? ১৯ মে শুক্রবার। সূর্য ওঠার অনেক অনেক আগে থেকেই সত্যাগ্রহী দল কেন্দ্রে হাজির। ভোর ৪-টে থেকে বিকেল ৪-টে পর্যন্ত হরতাল। সত্যাগ্রাহীদের হাতে হাতে সংগ্রাম পরিষদের ডিরেক্টরের ইস্তাহার। ‘১৯ মে কাছাড়বাসীর সামনে এক পরীক্ষা দিন। এই দিন প্রমাণ হবে আমরা আমাদের মাকে, মাতৃভাষাকে কতোটা ভালোবাসি। ভাষা দিয়েই জাতির পরিচয়। ভাষা না থাকলে জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আজ এই সংগ্রাম ভাষা ও ধর্ম রক্ষার সংগ্রাম। তাই আহ্বান জানাই। ওরে ভাই এগিয়ে এসো, তোমাদের মাতৃকণ্ঠকে অত্যাচারীর হাত থেকে মুক্ত কর উত্তর পুরুষের ভবিষ্যৎ নির্মল কর’। সত্যাগ্রহী দল ইস্তাহার বুকে চেপে ধরে মনে বল পায়, ধ্বনি দেয় —মাতৃভাষা জিন্দাবাদ। এর পর বিদ্রোহ আগুন-গুলির যন্ত্রণা-আর্তনাদ-রক্তের স্রোত। নয়টি মৃতদেহ আঁকড়ে সারারাত জেগে রইল শিলচর, বাইরে অঝর বৃষ্টি। সাত দিনের কারফিউ জারি হল শহরে। ২০ মে নয়টি মৃতদেহ নিয়ে কারফিউ ভেঙে বের হলো পথে। পর দিন আরও দুজন প্রাণ দিলেন। মোট ১১ জন শহীদ হলেন বাংলা প্রেমী। তাজা রক্ত গোলাপ – (১) কমলা ভট্টাচার্য (১৬) নামে এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বীরাঙ্গনা কিশোরী। তিনিই পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ। (২) শচীন্দ্র পাল (১৯), (৩) তরণী দেবনাথ (২১), (৪) হীতেশ বিশ্বাস (২৭), (৫) সত্যেন্দ্র দেব (২৪), (৬) চণ্ডীচরণ সুত্রধর (২২), (৭) বীরেন্দ্র সুত্রধর (২৪), (৮) সুনীল সরকার (১৬), (৯) কুমুদ দাস (আনু২২), (১০) সুকোমল পুরকায়স্থ (৩৬), (১১) কানাইলাল নিয়োগী (৩৭) মরণ সাগর পারে তাঁরা অমরত্ব লাভ করলেন।

অবশেষে চাপে পড়ে সরকার তড়িঘড়ি আইন (১৯৬০) সংশোধনের মাধ্যমে বরাক উপত্যকায় সকল প্রকার সরকারি যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাকে মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করল। বহু রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা অসমে দ্বিতীয় সরকারী ভাষার মর্যাদা পেল।

বলাবাহুল্য এই আন্দোলনে আহত হয়ে ২১ বছরযাবৎ যন্ত্রণা ক্লিষ্টজীবন কাটিয়ে মৃত্যুবরণ করেন কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস। তাকে ১২তম শহিদ বলা হলে বরাকের ভাষা আন্দোলনের ১৩ তম শহিদ ডি.ওআই.এফ.আই.-এর সক্রিয় সদস্য হলেন বিজন চক্রবর্তী (বাচ্চু)। দুঃখের বিষয় এর পরেও আরও দু-দফায় (১৯৭২ ও ১৯৮৬) বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছিল। বাঙালি মায়ের আঁচল শূন্য হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ভাষা দাঙ্গায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নিহত হন ডাঃ মনীষী দাস (১৪ তম শহীদ) এবং ১৯৮৬ সালে শহীদ হন দিব্যেন্দু দাস (১৫ তম শহীদ), জগন্নাথ দেব (১৬ তম শহীদ) প্রমুখ। শিলচর শহরের গান্ধী পার্কে এসকল শহিদের স্মরণে শহিদ স্মারক ফলক আছে।

 

ক্রমশ…… 

Back To Top