ভাষা আন্দোলন ও শতবর্ষের আলোকে ধ্বনিতত্ত্ববিদ মুহাম্মদ আব্দুল হাই

~মোহাম্মদ সাদউদ্দিন~

ভাষাবিদ আব্দুল হাই

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল প্রবাহে যার মৃত্যুতে কন্যা হাসিনাকে শোক জানান তার এক চিঠিতে তার অন্যতম হলেন অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ আব্দুল হাই। অন্যজন হলেন ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াঁ। অবিভক্ত ভারতের অবিভক্ত বাংলায় বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা যদি হন ভাষাবিদ জ্ঞান তাপস ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, তাহলে আব্দুল হাই অন্যতম রূপকার।

মুহাম্মদ আব্দুল হাই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রানীনগর থানার মরিচা গ্রামের ভূমিপুত্র। তাকে নিয়ে দুই বাংলা সেভাবে স্মরণ করতে দেখা যায় না। তবে স্বীকার করতে হবে বাংলাদেশে কিছু সাময়িক পত্র-পত্রিকা বা দৈনিক পত্র-পত্রিকায় অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাইকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। আর পশ্চিমবাংলায় সে রকম কিছু হয়নি। মুর্শিদাবাদেরই রানীনগর-সেখপাড়া এলাকা থেকে আজিজুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বৈশাখী পত্রিকা’ তাকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করেছে। তার জন্য আজিজুল ইসলামকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

প্রকৃত নাম আবুল বাশার মুহাম্মদ আবুল হাই। পরবর্তীতে মুহাম্মদ আবুল হাই নামে সবার কাছে জনপ্রিয় হন। মুর্শিদাবাদ জেলার রানীনগর থানার মরিচা গ্রামে ১৯১৯ সালের ২৬ নভেম্বর বুধবার ১০ টায় তার জন্ম হয় এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে। অবশ্য এন্ট্রান্স পরীক্ষার সার্টিফিকেটে হাই-এর জন্ম তারিখ হল ২ মার্চ ১৯১৯। পিতার নাম আব্দুল গণি, মাতার নাম মৈমুন্নিসা খাতুন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্বরেলে শিয়ালদা-লালগোলা শাখার বহরমপুর ষ্টেশনে নেমে বহরমপুর-সাগরপাড়া কিংবা বহরমপুর – গোপালপুরঘাট রুটের বাস ধরে সেখপাড়া বাস ষ্টেশনে নেমে সেখপাড়া- লোচনপুর রুটে পশ্চিমে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মরিচা গ্রাম। পদ্মা তীরবর্তী মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাজশাহীর কাছাকাছী রানীনগর থানা এলাকা। আব্দুল হাইদের পূর্বপুরুষ আলহাজ্ব ওসিউল্লাহ ছিলেন মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত পীর হয়ত চাঁদের বংশধর। আর আব্দুল আহি-এর মায়ের পিতৃপুরুষ ছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁ আমলে মরিচা ও রানীনগর এলাকার জায়গীরদার। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সমস্ত বিষয় সম্পত্তি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে হাই সাহেবের মামার বাড়ির বংশধররা সবাই রাজশাহী শহরে বসবাস শুরু করেন। পিতৃকুল ও মাতৃকুল-দুই দিকই ধর্মভীরু মুসলিম। দুই কলই ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্মভীরু। কিন্তু ধর্মান্ধ বা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। হাই সাহেবের দাদু সলিমুল্লাহ ও প্রপিতামহ ওসিউল্লাহ কোরআনের হাফেজ ছিলেন। আবার তার বাবা আব্দুল গণি ছিলেন পেশায় একজন শিক্ষক। রাজশাহীর পোরশা গ্রামের একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতেন।

আব্দুল হাই ছিলেন পিতা-মাতার কনিষ্ঠ পুত্র। তারা ছিলেন দুই ভাই ও সাত বোন। দুর্ভাগ্যের বিষয় শৈশব চার বোনের মৃত্যু হয়। হাই সাহেবদের সাত ভাই বোনের নাম যথাক্রমে আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবুল আজীজ, খোদেজা খাতুন (শৈশব মৃত), জেলেখা খাতুন (শৈশব মৃত), হালিমা খাতুন(শৈশব মৃত),মহম্মদ আব্দুল হাই, মরিয়ম খাতুন( বর্তমানে মৃত), আমেনা খাতুন (বর্তমানে মৃত)ও মমেনা খাতুন ওরফে মাজেরা।

আর পাঁচটা রক্ষণশীল অভিজাত মুসলিম পরিবারের সন্তানদের মতো আব্দুল হাই-এর শৈশব শিক্ষা ও বাল্যজীবন ইসলামিক পরিবেশ কাটলেও তিনি মুক্ত ছিলেন। মায়ের ইচ্ছানুসারে হাই সাহেবের উর্দু নিয়ে মাদ্রাসায় পড়তে হয়। হাই সাহেবদের পরিবারও মুক্তমনা ছিল। মরিচা গ্রামের পাশেই বর্ধনপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় তাকে ভর্তি করা হয়। রক্ষণশীল অভিজাত মুসলিম পরিবারের একটি কথা চালু ছিল উর্দু খানদানি ভাষা। তাই উর্দু শিখলেই তবে আভিজাত্যের পরিচয় ফুটে ওঠে। কৃতিত্বের সঙ্গে জুনিয়র মাদ্রাসা পাশ করার পর ১৯৩২ সালে তিনি রাজশাহী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। রাজশাহীতে তার বড় ভাই মুহাম্মদ আব্দুল আজিজের কাছে তিনি থাকতেন। রাজশাহী হাই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন ডঃ এ এস সেরাজুদ্দহার, আর এই দাহার সাহেবের কাছে তার সাহিত্য জীবনের শুরু। দাহার রাজশাহী হাই মাদ্রাসার পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। আর ওই শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তিনি গভীর জ্ঞান অর্জনের পথে অগ্রসর হন। রাজশাহী হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রবেশিকার প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। পড়ে তিনি ঢাকায় ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলজে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে এই কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বিভাগে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। আই এ পাস করার পর হাই নিজে মনস্থির করেন যে তিনি ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করবেন। অন্যদিকে তার মা জৌবন্নেসার ইচ্ছা ছিল ছেলে আরবী অনার্স নিয়ে পড়ুক। কিন্তু প্রখ্যাত ভাষা তত্ববিদ মহম্মদ শহীদুল্লাহর উৎসাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাই বাংলা অনার্সে ভর্তি হন। উল্লেখ, আব্দুল হাই ছিলেন শহীদুল্লাহ সাহেবের স্নেহভাজন ও অন্যতম প্রিয় ছাত্র। তখন বি এ অনার্স কোর্স ছিল তিন বছরের। ১৯৪১ সালে অনার্সে প্রথম প্রথমে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৪২ সালে এম এ পরীক্ষা বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আব্দুল হাই-ই প্রথম মুসলিম ছাত্র যিনি এই কৃতিত্বে অধিকারী ছিলেন। বিতর্ক, বক্তৃতা, নাট্যাভিনয় ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি দক্ষ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন হাই থাকেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। ছাত্রাবাসের বিভিন্ন দাবীদাওয়া নিয়ে স্নিগ্ধ অথচ আপোষহীন আন্দোলন করতেন।

প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি কথা উল্লেখ করতে হয়। সেটি হল ছাত্র অবস্থাতেই ১৯৩৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর মরিচা গ্রামের বিত্তশালী জমিদার আলহাজ্ব আতিউল্লাহ সরকারের পৌত্রী আজহাজ আলিমুদ্দিন সরকারের কন্যা আনিসা বেগমের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। আব্দুল হাই-এর তিন পুত্র ও পাঁচ কন্য। তাদের বয় ক্রমানুসারে নাম গুলি হল মুঞ্জুর হাসান(পুত্র), হাসিন জাহান(কন্যা), খুরশীদ জাহান(কন্যা), মাহমুদ হাসান(পুত্র), রওশান জাহান (কন্যা), নাসিম জাহান(কন্যা)ও মুহাম্মদ ইশতিয়াক জাহান (পুত্র)।

যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে একমাস শিক্ষকতা করেন। তার পর বেঙ্গল জুনিয়র এডুকেশন্যাল সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে বাংলার অধ্যাপক রুপে যোগদেন। ঢাকা সরকারী কলেজ অধ্যাপক, চট্রগ্রাম কলেজ, কৃষ্ণনগর সরকারী কলেজ অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে ওই বছরই ১১ সেপ্টেম্বর অপশন নিন্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের লেকচারার হিসাবে যোগ। রাজশাহী সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করা কালীন হাই-এর সঙ্গে অধ্যাপক এনামুল হকের পরিচয়। যাই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় ১৯৫০ সালে তিনি লন্ডন যান। সেখানে ভাষাতত্ত্বে এম এ ডিগ্রি লাভের পর ১৯৫৩ সালে পূর্বপাকিস্থানে ফিরে এসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে যোগদেন। বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি বহু গবেষণা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। গবেষণাগুলি তিনি গ্রন্থাগারে প্রকাশও করেন। বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গবেষকদের উৎসাহ দানের জন্য তিনি একটি ষাণ্মাসিক সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করেন। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করার সময় বিদেশেও তিনি ভিজিটিং অধ্যাপক হিসাবে ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনি বিজ্ঞানে অধ্যাপনা করেন। ভাষা সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি আমেরিকা, ভারত, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, প্রভৃতি দেশ সফর করেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে ভারতে মহীশুরের আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং সেখানে দুমাস কাল ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনি বিজ্ঞানের অধ্যাপনা করেন। আমেরিকা মিশৌরী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। তার অমর সাহিত্যিক কর্ম গুলি হল ঃ ১) ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান (অনুবাদ, ১৯৪৯, মুলঃ দি হিস্ট্রিক্যাল রোল অব ইসলাম, এম এল রায়), ২) সাহিত্য-রোল অব ইসলাম, এম এল এন রায়), (৩) সাহিত্যিক সংস্কৃতি (প্রবন্ধ সংগ্রহ,১৯৫৪), (৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ঃ আধুনিক যুগ ( সৈয়দ আলি আহসান সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৫৬, (৪) বিলাতে সাড়ে সাত’শ’ দিন ( ভ্রমণ কাহিনী, ১৯৫৮), (৫) তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (রম্য রচনা, ১৯৫৯), (৬) ভাষা ও সাহিত্য (প্রবন্ধ সংগ্রহ, ১৯৬০), (৭) এ ফোনটিক অ্যাড ফোনোলজিক্যাল স্টাডি অব নেজালস অ্যান্ড নেজায়িসন্স ইন বেঙ্গলি বেসড অন ইংলিশ অবজারভস অন প্রনান্সিয়েসন(১৯৬০), (৮) দি সাউথ স্ট্রাকচারস অব ইংলিশ অ্যান্ড বেঙ্গলি (সহকারী লেখক ডবলু জেবল, ১৯৬১), (৯) হারামণি, পঞ্চম খোন্দ, (অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৬১), (১০) মধ্যযুগের বাংলা গীতি কবিতা ( ডঃ আহমদ শরীফ সম্পাদিত, ১৯৬১), (১১) ট্র্যাডিশনাল কালচার ইন ইস্ট পাকিস্তান (সহকারী লেখক ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৯৬৩), (১২) বিদ্রোহী বাঙালি(১৯৫৯), (১৩) গল্প বিচিত্রা(সম্পাদিত গল্প সংকলন, ১৯৬৩), (১৪) ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ (সম্পাদিত, ১৯৬৪), (১৫) আসারায়ে মুবাশশারা বা দশ জান্নাত(১৯৫৬), (১৬) ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব(১৯৬৪), (১৭) বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ হ্যান্ড বুক (সহকারী লেখক- লেখিকা পুণ্য শ্লোকারাস ও মিসেস লীলা রায়,(১৯৬৬), (১৮) মানসিংহ- ভাবনন্দ- উপাখ্যান( অধ্যাপক আনোয়ার পাসা সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৬৭), (১৯) কালকেতু উপাখ্যান (অধ্যাপক আনোয়ার পাসা সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৬৮), (২০) প্রাকৃত প্রবেশিকা (অনুবাদ, ১৯৬৮০, (২১)বড়ু চণ্ডীদাস( অধ্যাপক আনোয়ার পাসা সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৬৮), (২২) চর্যা গীতিকা(১৯৬৮), (২৩) দীনবন্ধু রচনা সংগ্রহ( ডঃ আনিসুজ্জামান সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৬৮), (২৪) বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ ( ডঃ আনিসুজ্জামান সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৬৮), (২৫) ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ ( অধ্যাপক আনোয়ার পাসা সহযোগে সম্পাদিত, ১৯৬৯)।

অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই শুধু একজন বাংলা অধ্যাপক সাহিত্য , ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্বের লেখক ও মাতৃভাষা প্রেমিক ছিলেন না। ছিলেন একজন সুগভীর মাতৃভাষা প্রেমিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা কালীন যখনই মাতৃভাষা বাংলার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথা চাড়া দিয়েছে, তখনই তিনি প্রতিবাদী হয়েছেন। অধ্যাপক ও সাহিত্যসেবী হিসেবে অধ্যাপক আব্দুল হাই চিরকালই বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ ছিল। বাংলার বদলে উর্দু বা আরবি প্রচলন, আরবিতে বাংলা লিখন পদ্ধতির প্রবর্তন, রোমান হরফে বাংলা লেখার ব্যবস্থা, বাংলা বর্ণমালা শুদ্ধিকরণ, বাংলা বানান সংস্কার, রবীন্দ্র বিরোধী আন্দোলন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎখাত প্রচেষ্টা প্রভৃতির বিরুদ্ধে যিনি প্রবল ভাবে লড়াই করেছেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আব্দুল হাই চেয়েছিলেন মাতৃভাষা শুধু শিক্ষার মাধ্যম হোক তাই- নয় , অফিস আদালতের কাজকর্মের মাতৃভাষা চালু করতে হবে। আর তার জন্য আব্দুল হাই-এর উৎসাহ ও পরিশ্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ দিন ব্যাপী ‘ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ উদযাপিত হয় ১৯৬৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বাংলা ভাষা সাহিত্যের উৎপত্তি ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করাই ছিল এই কর্মসূচীর প্রধান উদ্দেশ্য।

বাংলা ভাষা বাঙালি সংস্কৃতিকে বিপন্ন করার জন্য সেদিন পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল আব্দুল হাই তার তীব্র বিরোধিতা করেন। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রবীন্দ্র বিরোধিতার যে ঢেউ ওঠে পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে, আব্দুল হাই তার সঙ্গে মোটেই সহমত পোষণ করতে পারেননি। ১৯৬৫ সালে পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথই শুধু নয়, হিন্দু-কবি লেখক উঠিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। আব্দুল হাই তার প্রতিবাদে গর্জে গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে বেতার রবীন্দ্র সঙ্গীত বর্জন করার ষড়যন্ত্র করে। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দেন। এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে প্রতিবাদে ঝড় ওঠে। ওই বছরই ২৪ জুন ১৯ জন বুদ্ধিজীবী ঘোষণা করেন ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করিয়াছে তাহা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করিয়াছে’। এই বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন তাদের অন্যতম অধ্যাপক আব্দুল হাই।আব্দুল হাই-এর নেতৃত্বে প্রবল আন্দোলনে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা প্রত্যাহার করে। রবীন্দ্র সাহিত্য ছিল হাই সাহেবের প্রিয় বিষয়। বিশ্বকবির সুরেই যেন তার সমস্ত জীবন ঝঙ্কৃত হয়েছে। কবি গুরুর স্বরেই বেজে উঠেছে হাই-এর হৃদয়ের স্বরলিপি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লেখেন তিনি। ছাত্র জীবনে রবিন্দ্রনাথের নাটকে অংশ গ্রহণ করেন। অধ্যাপক জীবনে রবীন্দ্র পঠন ও পঠনে সে আসক্তি বহুগুণে বৃদ্ধিপায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব পড়লেও রবীন্দ্র সাহিত্যের একটি ক্লাস তিনি নিতেন। রবীন্দ্র কবিতার তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত। রবিন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকীর সালটি ১৯৬১। ওই ১৯৬১ গবেষণা সাহিত্যের বিশেষ কৃতিত্বের জন্য বাংলা একাডেমী পুরষ্কার পান।

১৯৬৯ সালের ৩ জুন। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। আর পাঁচটা দিনের মতো ওই দিনও তিনি প্রাতঃভ্রমণে বের হন। স্ত্রী আনিসা বেগমকে বলে যান প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফিরে এসে তিনি সকালের খাবার খাবেন তার সঙ্গে। ঢাকার কমলাপুর স্টেশনের কাছে খিলগাঁও এলাকায় তারই এক প্রাক্তন ছাত্রের কাছে গিয়েছিলেন অন্য আর এক প্রাক্তন ছাত্রের ঠিকানা আনতে। আর সেখানেই ট্রেন দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল। স্ত্রী আনিসা বেগমের সঙ্গে তার আর সকালের খাবার খাওয়া হয়নি। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে ওই দিনই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় আব্দুল হাইকে সমাধিস্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালের জুলায় মাসে তার ছেলেরা কবরটি বাঁধিয়ে দেন। সেখানে স্থাপন করা হয় একটি স্মৃতিফলক। এই স্মৃতিফলক স্থপতি আলী ইমাম। সেই স্মৃতি ফলকে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের একটি সনেটও খোদিত করা হয়েছে। সনেট রুপায়নে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন কবি আব্দুল কাদির, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং মনছুরে মাওলা। সেই প্রস্তর ফলকে যা লেখা আছে তা হলঃ

মুহাম্মদ আব্দুল হাই

অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,

জন্ম-২৬ শে নভেম্বর, ১৯১৯

মৃত্যু – ৩’ রা জুন, ১৯৬৯

মরিচা, মুর্শিদাবাদঃ জন্মভূমি তাঁর।

আমৃত্যু রবীন্দ্র প্রেমে দীপ্তিমান শিখা;

প্রসন্ন পাণিনি ধ্যানে সম্পন্ন দীপিকা।

ধ্বনিতত্ত্বে কীর্তিমান; একান্ত সবার

স্মৃতিমান্য; মিতবাক, সুকৃত, সুজন।

বিপুল বিত্ত প্রাণ অধ্যাপক-যার

প্রীত কণ্ঠ বিদ্যাঙ্গনে ঝরেছে অপার।

অনন ব্যক্তিত্ব স্নিগ্ধ সুস্মিত আনন।

২০১২ সালের অক্টোবর মাসে আমি যখন ঢাকায় যাই তখন আজিমপুর কবরস্থানে গিয়েছিলাম। ওই কবরস্থানে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম দুই শহীদ আবুল বরকত ও শফিউর রহমানেরও কবর রয়েছে, জন্মসূত্রে একজন মুর্শিদাবাদের সালার থানার বাবলা গ্রামের সন্তান, অন্যজন হুগলী জেলার কোন্নগরের। কবর জিয়ারতের সময় সেদিন অশ্রুসজল হয়ে গিয়েছিলাম।

উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সাল্রের ১৩ জুন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ( অধুনা স্বাধীন বাংলাদেশ ) উত্তাল রাজনৈতিক প্রবাহের মধ্যে বাংলাদেশের স্তপতি ও সে দেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রবাসী কন্যা শেখ হাসিনা ( বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) একটি পত্র লেখেন। সেখানে অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল হাই এবং ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াঁর মৃত্যুর গভীর শোক প্রকাশ করেন।  

Back To Top