জল না পানি?

শব্দের ব্যবহার হিসেবে কোনটি সঠিক? জল না পানি!

~আনসারুল ইসলাম

বাংলার পরিবেশ এখন এতটাই উত্তপ্ত যে “জল”, “পানি” নিয়েও বিতর্ক হয়। একজন মুসলিম ছেলে স্কুলে পড়তে গেলে তার সংস্কৃতি বাঙালি নয় বলে তাকে অপমানিত করা হয়। অথচ ঘেঁটেঘুঁটে দেখলে দেখা যাবে ঐ মুসলিম ছেলেটিই আসলে বাংলা সংস্কৃতির সেই টিমটিমে প্রদীপ যে নিজের অজান্তেই বাংলার শেষ ঐতিহ্যকে হয়ত টিকিয়ে রেখেছে।

পরিস্থিতি এখন এমন আমরা অনেকেই প্রকাশ‍্যে “পানি” শব্দটি ব‍্যবহার করতে লজ্জা পাই। অথচ আদিকাল থেকে এই বাংলায় পানি শব্দটি ব‍্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু আমরা অনেকেই সেটা জানিনা। বরং জল শব্দটি অনেক পরে এসেছে। যা পান করা হয় তা পানি। পান শব্দটি আমরা অবলীলায় ব‍্যবহার করি। পানকৌড়ি, পানসে, পানিফল প্রভৃতি শব্দ ব‍্যবহার করতে লজ্জা নেই অথচ পানি বললেই অবাঙালি। তাই হয় নাকি!!

বাংলায় পানি শব্দের ব‍্যবহার আসলে সুপ্রাচীন। যারা মনে করেন বাংলায় ইসলামের আবির্ভাবের সময় থেকে বাংলার মানুষ পানি শব্দটি ব‍্যবহারে নিয়েছে তারা অত্যন্ত ভুল ভাবছেন। এবং এভাবে ভাষার ধর্মান্তকরণ আপনাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রকট করছে যা আজ নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকেই শব্দটি পাই আমরা। ১৯১৬ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা, অর্থাৎ “চর্যাপদ” বেরোয়। বাঙালি তার মাতৃভাষার আদি চেহারা দেখতে পায়।

চর্যার রচনার সময়কাল নিয়ে ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮০ – ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দ) তিব্বত যাত্রার পূর্বে (১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) লুইপাদের অভিসময়বিহঙ্গ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। একথা সত্য হলে লুইপাদ দশম শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান থাকবেন। অপরদিকে তিব্বতি কিংবদন্তী অনুসারে তিনিই সিদ্ধাচার্যদের আদিগুরু। অর্থাৎ, চর্যার সময়কালও দশম শতাব্দীর পূর্বে হতে পারে না।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেছেন।

এই সময়কালে রচিত চর্যাপদে দেখুন পানি শব্দের ব‍্যবহার :
“তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী । / হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী ।।” 
ভুসুকু পা’র এই দোহায় হরিণের ব্যাথিত হৃদয়ের প্রতিচ্ছবিটা চিরন্তন। ধৃত হরিণ প্রাণাশঙ্কায়, বিহ্বলতায় ঘাসও খায় না, “পাণী” পানও করেনা। খুঁজলে এরকম আরো হয়তো পাওয়া যাবে।

তাহলে এখন প্রশ্ন থেকে যায় এই পানি থেকে জল এর ব‍্যবহার কিভাবে আসল। এর একটিই উত্তর একসময় বাংলাভাষায় অতিরিক্ত সংস্কৃত শব্দের ডাইরেক্ট ব‍্যবহার। পানি এবং জল শব্দের উৎপত্তি দেখলেই এটি পরিস্কার বোঝা যায়।

পানি আসলে প্রাকৃত শব্দ, এটি তদ্ভব শব্দ হিসাবে বাংলায় বহুকাল আগে থেকেই ব‍্যবহৃত হয়ে আসছে। অনেকে পানি শব্দটি অপেক্ষাকৃত গরীব, অশিক্ষিত বাঙালি মুসলিম কৃষকদের মুখে শুনে থাকার কারণে এর মুসলমানিকরণ করতে গিয়ে এবং বাঙালি মুসলমানদের বাংলা থেকে আলাদা দেখানোর উদ্দেশ্যে এটাকে আরবি বা ফারসী শব্দ বলে প্রচার করেন। অনেকে এতটাই অজ্ঞ যে একে উর্দু ( যেহেতু এভাষাকেও অনেকে মুসলমানদের ভাষা মনে করে থাকেন ) থেকে বাংলায় এসেছে বলে থাকেন। আর সুচতুরভাবে হিন্দি ভাষার ( যদিও ওভাষাতেও এর ব‍্যবহার আছে) ব‍্যাপারটি লুক্কায়িত রাখেন।

অথচ পানি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ “পানীয়”-এর বিবর্তিত রূপ। বিবর্তনের ধারাটি এরকম
(সংস্কৃত) পানীয় –> (পালি) পানীয় –> (প্রাকৃত) পাণিঅ –> (বাংলা) পাণি/পাণী –> আধুনিক বাংলা পানি (অতীতে পানী বানানও প্রচলিত ছিল)। একই প্রাকৃত শব্দ “পাণিঅ” থেকে হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাতি, মৈথিলী ও ওড়িয়া ভাষাতেও পানি শব্দটি প্রবেশ করেছে। পানি-র সাথে আরবি বা ফারসী ভাষার কোন সম্পর্ক নেই। আরবিতে পানি হল “মাউন” এবং ফারসীতে পানি হল ‘আব’। সুতরাং “পানি” শব্দটি মুসলমান-রা এখন ব‍্যবহার করে বলে এটা অবাঙালি হতে পারে না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় একসময় এর ব‍্যবহার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালিই করতেন।

চর্যার পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একটি বড় উপাদান হল “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”। সেখানেও জল শব্দের পরিবর্তে পানির ব‍্যবহার লক্ষণীয় :

“কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হুআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।”

বাঁকুড়ার এক প্রত‍্যন্ত গ্রামে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের বাড়িতে অযত্নে রক্ষিত রাধা-কৃষ্ণের এই লীলাকাহিনীতে মুসলমানরা কি উদ্দেশ্যে উর্দু পানি ঢোকালেন বলতে পারেন ? এই পুরানো পুঁথিগুলি আবিস্কৃত না হলে মনে হয় বাংলার মুসলমানদের বাঙালীত্ব প্রমাণ করতে জীবন দিতে হত।

জল একটি তৎসম শব্দ যা সংস্কৃত জলম্ থেকে সরাসরি এসেছে। আদি বাংলায়, প্রাকৃত পানির ব‍্যবহার ছিল প্রমাণিত। তৎসম জল এর ব‍্যবহার ছিল কিনা প্রশ্নযুক্ত। তাই এর একটি ব‍্যাখা এরূপ হতে পারে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের সময় যখন বাংলা ভাষায় ব‍্যাপক সংস্কৃত শব্দের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, তখন লিখিত ভাষা হিসেবে এর আগমন ঘটে ও পরে এলিট বাঙালি থেকে সকল বাঙালির মুখের ভাষায় পরিণত হয়। 
আর যদি আদিকালে “পানি” ও “জল” দুটি শব্দের ব‍্যবহার থেকেও থাকে, এটা আপনাকে মানতেই হবে তখন বাংলার মানুষ পান করার জন্য ব‍্যবহৃত জলকে পানিই বলত। 
জনৈক শুভজিৎ সরকার মহাশয় এই বিরোধকে সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন – “যে পরিষ্কার বিভাজন আজ চোখে পড়ে, তার শুরু কিন্তু বিদ্যাসাগর সমকালে। লিখ্য ও সংস্কৃত ব্যাকরণ সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার প্রচার যতটা হিন্দু এলাকার বিদ্যালয়ে করা গেছিল, ততটা বৃহৎ বাংলার বিপুল গ্রামীণ রায়ত সমাজে ( মুলত: মুসলিম) নয়। ফলে যারা বেশি মাত্রায় আঞ্চলিক কথ্য ভাষার অনুগামী, সেই সব অঞ্চলেই দেশি বা বিদেশি শব্দে ভরা ভাষা চালু রইল বেশি, আর যারা ক্রমশ হোমোজিনিয়াস স্কুলে শিক্ষিত বাংলা চর্চা করতে লাগলো, সেই সব ক্ষেত্রে জল পেল ব্যাপকতর ব্যবহার।

পরবর্তী কালে দেশভাগের মাইগ্রেসান, আর এপার বাংলার আরো বেশি কল্কাত্তাইয়া লিখ্যভাষার দিকে পোলারাইজেশন, এই ফারাক টা প্রবলতর করেছে। একাধিক জেনারেশন ছাড়িয়ে, আজ যেমন পুরনো কলোনি অঞ্চলেও আর নানা বাঙাল কথ্য ডায়ালেক্ট কল্কাত্তাইয়া বাংলায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এই জল আর পানির ব্যাপারটাও সেরকম।”

সুতরাং বোঝা গেল জল শব্দটা সংস্কৃত ভাষার শব্দ; বাংলাতে অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, অর্থাৎ তৎসম। আর সংস্কৃত পানীয় প্রাকৃতে চেহারা বদলে পানি হয়েছে, যাকে বলি তদ্ভব। এই তদ্ভব শব্দগুলোই “খাঁটি বাংলা” এবং এরূপ শব্দ বা শব্দগুচ্ছকে অস্বীকার একমাত্র মূর্খগণই করবে। আমাদের প্রচলিত এই ভুল ধারণাটি সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে বেশ অনেক খানি জায়গা জুড়ে আলোচনা করেছেন। সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভুত পানি শব্দটি বহু অঞ্চলে প্রচলিত নয় বলে এটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অংশ নয় বলে ধারণা করা বড্ড একপেশে। বরং যারা জল বলেন তাদেরকেই এ প্রশ্নটি ছুড়ে দেওয়া যায় – আপনারা কোন যাদুবলে মুগ্ধ হয়ে বাংলার প্রাণের ভাষা “পানি” কে পরিত‍্যাগ করেছিলেন ?? বাংলার অন্ত‍্যোজ শ্রেণী, নেড়ে, যবন প্রভৃতিরা এই শব্দ ব‍্যবহার করত বলেই কি সংস্কৃত জলম্ এ প্রত‍্যাবর্তন ?? একসময় বাংলাভাষাকে যে ব্রাহ্মণ‍্যবাদের প্রভাবে অতিরিক্ত সংস্কৃত ভাষায়ণ করা হয়েছিল তা কি আপনি অস্বীকার করতে পারেন ??

আর যদি ভাষার শুদ্ধিকরণের কথা বলেন তাহলে ভাষার ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভাষায় এই শব্দোদ্বয়ের ব‍্যবহার দেখে বলতেই হয় সমস্ত রকমের আকছার ব‍্যবহৃত জলকেই পানি বলা উচিত এবং বিশেষভাবে গুরুত্বযুক্ত পানি কে জল বলা উচিত। যেমন গোলাপ জল, গঙ্গা জল, ক‍্যাওড়া জল, বৃষ্টির জল, জলীয় বাষ্প প্রভৃতি। আবার চোখের পানি, খাবার পানি, খাল বিল নদী-নালার পানি, পান করার জন্য ব‍্যবহৃত পানি প্রভৃতি।

কিন্তু বাংলাভাষা যেহেতু গতিময় এবং বিভিন্ন শব্দের সংমিশ্রণে এভাষা এক আলাদা মাধুর্য পেয়েছে তাই এই ব‍্যবহারবিধি কোনো কাজের কথা নয়। জল ও পানি উভয়কেই একই শব্দ হিসাবে গ্রহণ করা কর্তব‍্য। এটা বিতর্কিত কোন বিষয় নয় এবং কোন একটিকে বাতিল বলে ঘোষণা করা কোন কাজের কথা নয় বরং এটি একই শব্দের ভিন্নরূপ হিসাবে বাংলাভাষার গুণবৃদ্ধি করুক।

বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার দেশী, বিদেশী, সংস্কৃত – যে ভাষা থেকেই আসুক না কেন, এখন তা বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উর্দু শব্দ হলেও তা সমস্যার নয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিতাম পানি শব্দটির মূল উৎস আরবি, তাহলেই বা কী দাঁড়াতো? কলম, কাগজ, আদালত এসব শব্দও তো আরবি। তাহলে এসব শব্দ বাদ দিতে হবে? আনারস পর্তুগীজ ভাষা থেকে আসা, তাও বাদ দিবো? সংস্কৃত তৎসম শব্দ ছাড়া বাংলাভাষার আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করা যাবে না? যদিও সৌভাগ্যবশত, সংখ্যাগুরু বাঙালিরা এসব গোড়ামী থেকে মুক্ত এবং জল, পানি, কাগজ, কলম – সব শব্দই বিশুদ্ধ বাংলার অংশ হিসাবে দৈনন্দিন জীবনে শত শত বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে। ভাষা বিষয়ক এসব ভুল ধারণার অবসান কায়োমনবাক‍্যে কামনা করি।

বিঃদ্রঃ নিচে চর্যাপদ এর একটি অংশ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর শব্দসূচী রেফারেন্স হিসাবে দেওয়া হল।”

Back To Top