ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দি (সোহারাওয়ার্দি): মুসলিম সমাজের বিদ্যাসাগর


ওবায়দল্লাহ আল অবায়দি 
সোহারাওয়ার্দি


~ মুহাম্মদ সাদউদ্দিন সাহেবের লেখা (বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক)

ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বীরসিংহ গ্রামে । পরবর্তী কালে তিনিই সবার কাছে জনপ্রিয় হন বিদ্যাসাগর হিসাবে। কিন্তু মেদিনীপুর জেলারই মেদিনীপুর শহরের আরও এক সন্তান কে বলা হয় মুসলিম সমাজের ‘বিদ্যাসাগর’ ( আরবীতে ‘বাহারুল উলুম’ তার নাম আমরা কি জানি? হ্যাঁ তিনি হলেন ওবায়দল্লাহ আল অবায়দি সোহারাওয়ার্দি । মেদিনীপুরের বিখ্যাত সোহারাওয়ার্দি পরিবারে ১৮৩২ সালে তিনিজন্ম গ্রহন করেন। সুদূর ইরাকের ( সাহারও সহর থেকে তাদের পূর্ব পুরুষরা বাংলায় এসে মেদিনীপুর শহরে বসতি স্থাপন শুরু করেন। শিক্ষাবিদ, প্রাচ্যবিদ্যাবিদ, কবি , দার্শনিক, সমাজ সহ নানান গন ও বুহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ওবায়দি সাহেব। ১৮৫৭ সালে কলকাতা মাদ্রাসা কলেজ থেকে ফাইনাল সেন্ট্রাল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। আরবী, ফার্সি, ও ইংরেজি ভাষাকে তিনি খুব অল্প বয়সেই রপ্ত করেন । ছাত্র জীবনে ইংরেজি ও বিজ্ঞানে খুবই পারদর্শী ছিলেন। প্রথম জীবনে চাকুরি করেন কলকাতার মহীশুর রাজ পরিবারের মোসাহেব হিসাবে । তার পরে কর্ম জীবন শুরু হয় ভাইস বিগ্যাল লেজি সিলেটিব কাউন্সিলের অনুবাদ  বিভাগের প্রধান মুন্সি হিসাবে ১৮৬২ সালে। ১৮৬৫ সালে হুগলী কলেজে ( বর্তমানে হুগলী মহসীন কলেজ) অ্যাংলো অধ্যাপক হিসাবে চাকুরিতে যোগ দেন। আর ওই কলেজে ছাত্র হিসাবে পান স্যার সৈয়দ আমীর আলীকে।হুগলী কলেজে ৯ বছর অধ্যাপনার চাকুরি করার পর ১৮৭৪ সালে চলে যান ঢাকা মাদ্রাসাতে। সেখানেতিনি নিযুক্ত হন সুপারিন্ডেন্ট পদে । হুগলীর ইমাম বাড়ার রক্ষনা- বেক্ষনা কারী ( আরবীতে বলা হয় ‘মুত ওয়াল্লি;) সৈয়দ কেরামত আলীর সঙ্গে ছিল তার খুবই অন্তরঙ্গতা । ঢাকা মাদ্রাসার সুপার হিসাবে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন ওয়ারদি । আর এখানেই কায়কবাদ (কাসেম আলী কোরেশী) ওজনাব বাহাদুর আব্দুল আজিজ ছিলেন সুযোগ্য ছাত্র। ঢাকার নবাব আহসুল্লাহ- র সঙ্গে তারছিল  গভীর সম্পর্ক । এক সময় আলিগড় মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ডিরেক্টর ও হয়ে ছিলেন। আর সেই সুবাদে আলীগড় আন্দলনের প্রাণ পুরুষ স্যার সৈয়দ আহমেদের সঙ্গেও তার ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৮৬৪ সালে‘রেসিপ্রকাল ইনফ্লুন্স  অব মহামেডান অ্যান্ডইউরোপী’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন । চালস ট্টিভলিয়ন ঘোষিত পুরুস্কার লাভ করেন ।পরবর্তী কালে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপ এই প্রবন্ধটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা ও বিশেষজন প্রিয়তা লাভ করে। হুগলীতে থাকা কালীন তিনি স্যার সৈয়দ আমীর আলি একত্রে সৈয়দ কেরামতআলীর ‘মখজুল উলুম’ ফারসি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেন। কবিতা সংকলন ‘ দিওয়ান-ই-ওবায়দি’১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় । ১৮৮৭ সালে ‘দস্তুরি ফারসি আমোজ’  নামে একটি ফারসি গ্রন্থ ও রচনা করেন তিনি। তাঁর গ্রন্থগুলি হল ‘লুব্বুল আরব (আরবি ব্যাকরণ) , ‘মিফতাহুল আদার’( উর্দু ব্যাকরণ) , তদবিরতুল্লার -কি-ছিয়াগিলন কিবার আবওয়ার’( আরবি সাহিত্য), ‘তরাকুল আজহার- ফি-সিয়ারিল-ফালাসি-কাতিলকিবার’ ( গ্রিক দার্শনিকদের ইতিহাস), ‘দাবিতস্তা-ই-দানিস-আমুস’( উর্দু পদার্থ বিদ্যা),দস্তর-ই- পারসি-আমুস,(ফারসি ছন্দ ও অলঙ্কার) , ‘ আল মনাহিলুস সাফিয়া- ফি- মাসায়েল-জাগ্রাফিয়া’( আরবী ভূগোল), ইত্যাদি। এছাড়া রাজা রাম মোহনের রায়ের ‘তুহফাতুল মওয়াহেদীন’ ফারসিওগ্রন্থটিও অনুবাদ করেন। এক সময় ওবায়দি ঢাকার মিউনিসিপ্যাল কমিশনার ও সম্মানীয় ম্যাজিস্ট্রেটও হন। ঢাকার সামাজিক ও সংস্কৃতি জীবনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগছিল।

ঢাকা ‘সমাজ সম্মেলনী’ সভাও তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ১৮৭৯ সালে। কাজ, সমাজ সেবা ও সাধনার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘বাহারুল উলুম’ (বিদ্যাসাগর) উপাধি দেয়। ১৮৮৫ সালে (মতান্তরে ১৮৮৬) ২৯ ফেব্রুয়ারী এই জ্ঞানতাপসের জীবনাবসান ঘটে। ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী , উদারপন্থি , বহুভাষাবিদ, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক হিসাবে জ্ঞানতাপস তখনকার দিনে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এক সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও তাকে খুবই স্নেহ করতেন। এই জ্ঞানতাপসের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আচার্য ইরিনাথ দে একটি তৈলচিত্র্যও প্রস্তুত করেন। মুসলিম সমাজের এই (বিদ্যাসাগর)  কিন্তু আজ ইতিহাসের পাতায় ঠাই পাননি। এর চেয়ে আর দুঃখের কী হতে পারে ?

ওবাইদি সাহেবের দুই পুত্র । আব্দুল্লা আল-মামুন  সোহারাওয়ার্দি (১৮৭০-১৯৩৫) ও হাসান  সোহারাওয়ার্দি দুজনেই উচ্চশিক্ষিত ।  আব্দুল্লাহ মুসলিম আইন নিয়ে গবেষণা করে। পিএইচডি  করেন হাসান  সোহারাওয়ার্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে তিনিই প্রথম এফ আর সি এস।

Back To Top